বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২০ পূর্বাহ্ন

আতঙ্কের নাম রাসেলস ভাইপার অ্যান্টিভেনম না মেলায় বাড়ছে মৃত্যু

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪
  • ৯৬ Time View

শতাব্দী ডেস্ক : দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদে গত কয়েক বছর ধরে ছড়িয়ে পড়েছে বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার। বিশেষ করে পদ্মাবেষ্টিত জেলাগুলোয় এ সাপের দেখা মিলছে হরহামেশাই, এদের আক্রমণের শিকারও হচ্ছে বহু মানুষ। এছাড়া পদ্মা ও মেঘনা হয়ে এই সাপ এখন চাঁদপুর, চট্টগ্রামেও পাওয়া যাচ্ছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত পদ্মার তীরবর্তী রাজশাহী, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় রাসেলস ভাইপারের দংশনে অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মাঝে চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চরাঞ্চলেই বিষধর রাসেলস ভাইপারের দংশনে প্রাণ হারিয়েছে পাঁচজন।

মূলত হাসপাতালগুলোতে এর অ্যান্টিভেনম না পাওয়ায় বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। এখনও এই বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরি করেনি দেশীয় কোনো ওষুধ প্রতিষ্ঠান। যদিও পাশ্বর্তী দেশ ভারত থেকে কিছু আমদানি করা হয় কিন্তু প্রয়োজনের সময় হাতের কাছে পাওয়া যায় না। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, সাপের দংশনে রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি, ধরন একেক রকম।

ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর মাত্র ২০ শতাংশ বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। অথচ বছরের পর বছর ভারতে তৈরি অ্যান্টিভেনম দিয়েই বাংলাদেশে সাপের দংশনের শিকার রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে আশার বিষয় হলো, দেশে সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা চলছে। সাপের দংশনে মৃত্যু কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে দেশে বিচরণ করা সাপের ভেনম তৈরির গবেষণা চলছে।

ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, সাপের কামড়ের ওপর আমরা জাতীয়ভাবে জরিপ করেছি। এতে দেখেছি দেশে প্রতিবছর প্রায় সাত হাজার ৫০০ মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। আর চার লাখের বেশি আমাদের দেশে সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটে। ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, আমাদের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের প্রধান লক্ষ্য ছিল, বিষধর সাপ সংগ্রহ করা। তারপর তাদের লালন-পালন করা ও বিষ সংগ্রহ করা। বর্তমানে সাপের বিষ সংগ্রহের কাজ চলছে। আমাদের দেশের ১১ জাতের বিষধর সাপের অ্যান্টিভেনম সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে দ্রæত অ্যান্টিভেনম তৈরি সম্ভব নয়। এর প্রক্রিয়া অনেক লম্বা। এখন এ ভেনমের অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান। আবার এ ধাপের অনেক পরীক্ষা আমাদের দেশে হয় না।

সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর সহযোগিতায় কিছু ভেনম স্পেনের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। আমাদের ভেনমের স্বভাব চিহ্নিত করতে হবে। ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, এখনো অ্যান্টিভেনমের সফলতার মুখ না দেখা গেলেও রাসেলস ভাইপারের ভেনম থেকে আমরা অ্যান্টিবডি তৈরি করছি। আমরা প্রথমে রাসেলস ভাইপারের ভেনম নির্দিষ্ট পরিমাণ মুরগিকে দেই। মুরগির ডিমে অ্যান্টিবডিগুলো থাকে। এরপর ডিমের অ্যালবুমিন থেকে অ্যান্টিবডি সংগ্রহ করি।

এ ছাড়া ছাগলের শরীরে ভেনম প্রয়োগ করেও রক্ত সংগ্রহ করে তাদের থেকে অ্যান্টিবডি আলাদা করা হয়েছে। এখন অ্যান্টিবডি পিউরিফিকেশনের কাজ চলছে। এরপর আমরা ইঁদুরের শরীরে সেটা প্রয়োগ করে যাচাই করবো আমাদের দেশে তৈরি অ্যান্টিবডি কতটুকু কার্যকর। আমরা যে ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরির চেষ্টা করছি তা দিয়ে রাসেলস ভাইপারের কামড়ের চিকিৎসা শতভাগ সম্ভব হবে, যেখানে ভারতের অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের পরও রাসেলস ভাইপারে কামড়ানো রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই অ্যান্টিবডি আলাদাকরণ ও পিউরিফিকেশনের ফলাফল দেওয়া এবছরের মধ্যে সম্ভব জানিয়ে ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, অ্যান্টিবডি আলাদাকরণের তথ্য নিয়ে আমাদের প্রজেক্ট এ বছর শেষ হবে। এ ছাড়া সামনে ভালো পরিমাণ ভেনম যদি থাকে, ম্যাপিং করা থাকে এবং ক্যারেক্টার আলাদা করার কাজ হয়ে যায় তাহলে আমরা অ্যান্টিভেনম বানানোর প্রক্রিয়ায় অনেক দূর এগিয়ে যাবো।

জানা যায়, দেশে প্রায় ১০৪ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩০ প্রজাতির সাপ বিষধর। বিষধর সাপের মধ্যে রাসেলস ভাইপারও আছে। রাসেলস ভাইপার শুকনো বা ভাটি অঞ্চলে থাকে। তবে এরা পানিতেও সমান ভাবে থাকতে পারে। এরা ডিম না পেড়ে বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় এদের প্রজনন বেশি। অনেক ক্ষেত্রে চরাঞ্চলে কচুরিপানার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকতে পারে। রাসেলস ভাইপার একসঙ্গে অনেক বাচ্চা জন্ম দেয়। অনেক বছর দেশে রাসেলস ভাইপারের খবর ছিল না।

২০১১-১২ সালের দিকে রাজশাহীর তানোরে রাসেলস ভাইপার দেখা যায়। এরপর রাজশাহীতে সীমাবদ্ধ না থেকে পদ্মা, যমুনা দিয়ে মেঘনা হয়ে চাঁদপুরে যায়। এখন মানিকগঞ্জে অনেক পাওয়া যাচ্ছে। পানির অববাহিকা দিয়ে রাসেলস ভাইপার চলাচল করে। রাসেলস ভাইপার দ্রুত বংশবৃদ্ধি করছে এবং বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েও পড়ছে। অন্যদিকে, রাসেলস ভাইপারের রং অনেকটা জমির রঙের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় কৃষকরা ঠিকমতো খেয়াল করেন না। কাজ করতে গিয়ে দংশনের শিকার হন।

সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ হলো, যেকোনো ধরনের সাপ দংশন করলে শান্ত থাকতে হবে এবং দ্রæত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। শরীরের যে স্থানে দংশন করেছে সেটি যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করতে হবে। ঘড়ি বা অলংকার পরে থাকলে তা খুলে ফেলতে হবে। কাপড় দিয়ে দংশনের জায়গাটা বাঁধলে ঢিলে করতে হবে, তবে খোলা যাবে না। সাপের দংশনের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা যাবে না।

দংশনের স্থান আরও কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা যাবে না। বরফ, তাপ বা কোনো ধরনের রাসায়নিক কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা যাবে না। আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা রাখা যাবে না। দ্রæত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বৃষ্টির সময় বা বর্ষাকালে নিচু এলাকা ডুবে গেলে সেখান থেকে সাপ শুকনো জায়গায় আশ্রয় নেয়। এ সময় সচেতনতা অনেক বেশি প্রয়োজন। কৃষিজমিতে নামার আগে কৃষকদের জিন্সের প্যান্ট পরে নামা উচিত, যাতে সাপের কামড় না লাগে।

এ ছাড়া মাঠে নামার আগে বাঁশ দিয়ে নাড়িয়ে নেওয়া উচিত। তাহলে সাপ থাকলে তারা চলে যাবে। সাপে দংশন করলে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। দেশে যে অ্যান্টিভেনম পাওয়া যায় তা চার ধরনের সাপের দংশনের পর ব্যবহার হয়। রাসেলস ভাইপারের ভেনম তৈরিতে গবেষণা চললেও এখনো সফলতা আসেনি। দেশের বেসরকারি কোনো ওষুধ কোম্পানিও অ্যান্টিভেনম বানায়নি। এ কারণে রাসেলস ভাইপার সাপের দংশন থেকে সতর্ক থাকতে হবে।

আপডেট সংবাদ পেতে শতাব্দীর কন্ঠ পড়ুন, শেয়ার করে সাথে থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
All rights reserved © Shatabdir Kantha . Developed by SDTT Academy & Tech Liberty