আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে ১ম পর্ব।
চলুন পাঠক গ্রীক পৌরাণিকের ভেলায় চড়ে হাজার হাজার বছর আগেকার হারকিউলিসের রাজ্যে। অর্ধ-মানব, অর্ধ-অশ্ব আকৃতির অদ্ভুত আদিবাসীদের যুগে। সেদিন অলিম্পাস পর্বতমালার শীর্ষ দেশে অবস্থিত দেবরাজ্যের অনেক দেব-দেবী স্বর্গরাজ্য ছেড়ে মর্তের এক ভূখণ্ডে আবির্ভুত হন অভূতপূর্ব এক অলৌকিক এবং সুন্দর্যমন্ডিত পরীক্ষা দর্শনে। জিউসের কন্যা জ্ঞান-বিজ্ঞান, চারুশিল্প ও যুদ্ধের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ‘এ্যাথিনী’ এবং সাগর-মহাসাগর, হ্রদ-নদীর অধিকর্তা ‘পোসাইডন’-এর মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই সুন্দর ও অলৌকিক শক্তি পরীক্ষা।
কারণ, গ্রীসের এ্যাটিকা প্রদেশের পশ্চিমাংশের প্রশস্ত সমতল ভূমির মধ্যভাগে অবস্থিত উচু এক পার্বত্য টিলাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অনিন্দ সুন্দর এক নগরীর আধিপত্যকে কেন্দ্র করে তুমুল দ্ব›দ্ব বাঁধে দেবী এ্যাথিনী এবং জিউসের ভাই সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের মধ্যে। শেষে স্থির হয় যিনি উক্ত নগরীকে সবচেয়ে মুল্যবান উপহার দিতে পারবেন তাঁর নামানুসারেই হবে নগরীর নাম এবং তিনিই হবেন নগরীর রক্ষাকর্তা।
দেবতাদের উৎকণ্ঠা আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শুরু হল পরীক্ষা। পোসাইডন তার দ্বিশূল দিয়ে আঘাত করলেন পর্বতে, পর্বত থেকে নেমে এল ঝরনা ধারা। দেবী এ্যাথিনী তাঁর বর্শা দিয়ে আঘাত করলেন মাটিতে, সৃষ্টি হল জলপাই গাছ। এ্যাথিনী নির্বাচিত হলেন নগরীর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁর নামানুসারেই রাখা হলো নগরীর নাম এ্যাথেনা। আজকের এ্যাথেন্সই হল সেই পূণ্য নগরী এ্যাথেনা।
পবিত্র এ্যাথেনা নগরীকে তখনকার গ্রীক নগর রাষ্ট্রের মানুষ তীর্থ ভ’মিতে রূপান্তরিত করতে একে একে গড়ে তুলে ছিল রানি হেরার মন্দির, দেবরাজ ও স্বর্গ-মর্তের অধিপতি জিউসের বিশাল মূর্তি, দেবী এ্যাথেনীর মন্দির সহ বহু দেব-দেবীর মূর্তি ও মন্দির। সে সব মন্দিরে বছর জুড়েই চলত নানা পূজো-উৎসব। আবার সুনির্দিষ্ট কিছু দিন, মাস বা বছর পর পর অনুষ্ঠিত হতো বড় ধরনের উৎসব।
এরকম কোন এক উৎসবকে কেন্দ্র করেই পূজা-অর্চনার বাইরে গান-বাজনা, বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা আর খেলাধূলার আয়োজন হতো। যা কালক্রমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং নিয়মিত বড় আকারে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। যা আজ বিশ্ববাসীর নিকট আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক হিসেবে পরিচিত।
গ্রীক পুরাণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য : আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর পূর্বে নিছক দেব-দেবীদেরকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস আজকের মানব জাতির কাছে অনেকটাই অজ্ঞাত। এখনকার মতো তখনকার যুগে কোনে কিছুর জন্মকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখিত আকারে সংরক্ষণের কোন সুব্যবস্থা না থাকায় আদি অলিম্পিক ঘিরে যে সকল রূপকথা, লোককথা, কুড়িয়ে পাওয়া বিভিন্ন পুঁথি এবং গ্রীক পৌরাণিকে বর্ণনিত ঘটনাকে ভিত্তি করেই প্রাচীন অলিম্পিকের ইতিকথা আজ রচিত।
গ্রীক পৌরাণিকে উল্লেখ আছে- দেবরাজ জিউস তার তাঁর শিশুখেকো পিতা করোনেসকে যুদ্ধে হারিয়ে পৃথিবীর ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান করেন। যুদ্ধ জয়ের আনন্দকে উপভোগ করতে জিউস যে ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন করেন তাই অলিম্পিয়াড বা অলিম্পিক নামে খ্যাত হয়। পৌরাণিকের আরেক কিংবদন্তি গল্পে আছে- রাজকন্যা হিপ্পাডামিয়াকে বিয়ে করার জন্য গ্রীক বীর পেলোপস রাজা অনিমাসের বিপক্ষে এক রথ রেসের আয়োজন করেন, অলিম্পিকের উৎপত্তি তখন থেকেই।
প্রাচীন লোককথা থেকে জানা যায়, পৃথিবী দখলের জন্য অলিম্পাস পর্বতের চ’ড়ায় গ্রীক দেবতা জিউসের সাথে ক্রোনারদের ভীষণ যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে জিউস জয় লাভ করেন। সেই জয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই নাকি শুরু হয় এই প্রতিযোগিতার। প্রাচীন গ্রীকরা ছিলেন সৌন্দর্যের উপাসক ঈশ্বর ভক্ত। অলিম্পিককে তারা অধ্যাত্মিক উৎসব হিসেবেই মনে করতেন। আর গ্রীক সংস্কৃতিতে অ্যাথলেটিক্স ছিল তাদের আরাধনারই একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
গ্রীক পুরাণ থেকে জানা যায়- এ্যাথেনার মূল অংশ থেকে দূরবর্তী উপত্যকায় প্রায় ৪০ হাজার দর্শক জড়ো হতো গেমস উপলক্ষ্যে। আর সেখানেই অলিভ তেল মাখা চকচকে অ্যাথলেটরা নগ্ন হয়ে অংশ নিতেন শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায়। প্রাচীন গ্রীকদের বিশ্বাস ছিল ক্রীড়া হচ্ছে দেবতাদের মনোরঞ্জনের সর্বোত্তম উপায়। আর দেবতারা যার দিকে সুদৃষ্টি দেন সেই জয় করে নেয় বিজয়ীর মুকুট।
প্রতিযোগিতা শুরুর আগে অ্যাথলেটরা সারি বেঁধে দেবরাজ জিউস, দেবী হেরা সহ আর সব দেবদেবীর মূর্তির সামনে দিয়ে প্যারেড করে যেত। তারপর ৪০ ফুট উচু জিউসের মূর্তির পাদদেশে ষাঁড় আর শূকর বলি দিয়ে তার মাংস পবিত্র অগ্নিতে ঝলসে নিত। সেই সাথে শুরু হয়ে যেত প্রতিযোগিতা। উদ্বোধনী ও সমাপনী দিনে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এবং তাঁর বন্দনা করে শপথনামা পড়া হতো জিউসের মূর্তির সামনে।
(আগামীকাল পড়ুন ২য় পর্ব)