আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে ৬ষ্ঠ পর্ব।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
আদি অলিম্পিকে নারী : আদি অলিম্পিকের প্রথম দিকে নারীদের অংশগ্রহণ দূরের কথা, দর্শক হিসেবে প্রতিযোগিতা দেখতে আসা বিবাহিত নারীদের জন্য ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। কুমারী মেয়েরা অবশ্য দর্শক হতে পারত। তবে এ নিয়ম ভাঙার এক গল্প পাওয়া যায় পসানিয়াসের পুঁথিতে। ছেলের খেলা দেখতে ক্যালিপেটোরিয়া নামের এক বিধবা মহিলা জিমন্যাসটিক্স ট্রেনারের ছদ্মবেশ নিয়ে ছিলেন। ছেলে পিসিডোরাস জিতার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন তিনি, সেই সাথে তার পরিচয় যায় প্রকাশ হয়ে। কিন্তু ক্যালিপেটোরিয়ার বাবা, ভাই এবং ছেলের সম্মানে তাকে কোন সাজা দেয়া হয়নি। কারণ তারা সবাই ছিলেন অলিম্পিকের বিজয়ী বীর। তবে এরপর থেকে আইন করা হয়, ভবিষ্যতে প্রশিক্ষকদের ঢুকতে হবে নগ্ন হয়ে।
অলিম্পিকে যখন নারীর অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল, তখনও বিজয়ী হিসেবে নারী বিজয়ীর নাম নথিভ’ক্ত পাওয়া যায়। প্রথম অলিম্পিক বিজয়ী হিসেবে ঘোড়ার প্রশিক্ষক স্পার্টান রাজকুমারী সিনিস্কার নাম উল্লেখ আছে। তবে অন্য একটি বর্ণনায় প্রথম রথ রেস বিজয়ী নারীর নাম নথিভুক্ত আছে এভাবে- ‘বেলেসটিসে’, মেসোডনিয়ান সমুদ্রউপক’ল থেকে আসা এক নারী।
অলিম্পিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম নথিবদ্ধ মহিলাদের প্রতিযোগিতা ‘হেরিয়ান রেস’-এর সূচনা হয় অন্ততঃ খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতাটি অলিম্পিক গেমসের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। যুবতী মহিলাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় তিনটি বয়স ভিত্তিক দলে বিভক্ত হয়ে লড়তেন প্রতিযোগীরা। ‘হেরিয়ান রেস’ বিজয়িনী দেবী হেরার পূজারিনী হবার গৌরব অর্জন করতেন।
দ্বিতীয় প্রতিযোগিতাটি হত হেরার মন্দিরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পূজারিনীর সঙ্গী নির্বাচনের জন্য। পসানিয়াস ও অন্যান্য গ্রীক লেখকদের লেখা থেকে জানা যায়, হিপ্পোডামিয়া পেলোপ্সের সাথে তার বিয়ের খুশিতে ষোলোজন মহিলার একটি দল গঠন করেন ‘হেরিয়া ক্রীড়া প্রতিযোগিতা’র প্রশাসনিক কাজের জন্য। দেবী হেরার সম্মানে অনুষ্ঠিত সবচেয়ে বিখ্যাত দৌড়টিতে মহিলা, তরুণী এবং বালিকাদের রেস হত আলাদা ভাবে। তবে তাদের জন্য দূরত্ব ছিল পুরুষদের চেয়ে অনেক কম।
আদি অলিম্পিকে শক্তিবর্ধক-ঘুষ ও কূটকৌশল : এখনকার মতো তখনও প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হতে প্রতিযোগীরা নানা ক’টকৌশল গ্রহণ করত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে অউন্ননত হওয়ায় সে সময় চিকিৎসকের স্থলে জ্যোতিষী ও জাদুকরের দারস্ত হত। ২৩টি ইভেন্ট নিয়ে অনুষ্ঠিত আদি অলিম্পিক শুরু হবার আগে থেকেই হাল আমলের অ্যাথলেটদের মতো শক্তিবর্ধক ওষুধ যোগাড়ে লেগে যেত প্রতিযোগীরা। নিজের বিজয় নিশ্চিতে অ্যাথলেটরা তাবিজ আর পানীয় পাওয়া এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর পরাজয় নিশ্চিত কল্পে ইন্দ্রজালের ব্যবস্থা করতে জ্যোতিষী ও জাদুকরের কাছে যেত। পারফরম্যান্স বর্ধক নানা ধরনের গাছ গাছরার তৈরি ওষুধ-পথ্য সেবন করতেন। অবশ্য ধরা পড়লে জরিমানা তো ছিলই, চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেত অলিম্পিকের দরজা। তা সত্তে¡ও প্রাচীন অলিম্পিক ঘুষ, দূর্নীতি ও রাজনৈতিক কুপ্রভাব মুক্ত ছিল না।
প্রথম নথিভুক্ত প্রতারণার প্রামাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৮ সালে। থেসালিয়ার মুষ্টিযুদ্ধা ইউপোলাস তার প্রতিদ্ব›দ্বীকে ঘুষ দিয়ে ছিলেন। এমনকি কোন কোন অ্যাথলেট টাকার বিনিময়ে নিজের দেশের পরিবর্তে অন্য দেশের হয়ে লড়াই করারও নজির আছে। গ্রীক ইতিহাসবিদ পসানিয়াসের বর্ণনায়- নিরানব্বইতম ফেস্টিভ্যালে দীর্ঘ দৌড়ে বিজয়ী সোটাডেস নিজেকে একজন ক্রেটান ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু উৎসবের সময় নিজেকে একজন ইফিসিয়ান বানিয়ে ছিলেন। নিজের পরিচয় গোপন করতে ইফিসিয়ানদের ঘুষ দিয়ে ছিলেন। উত্তেজিত জনতা অলিম্পিয়াতে নির্মিত তার আবক্ষ মূর্তি ভেঙ্গে চ’ড়মার করে ফেলে, তার বাড়িকে পরিণত করে কারাগারে এবং তাকে পাঠায় নির্বাসনে।
রোমান সম্রাট নিরো ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ৬৭ সালে কবিতা পাঠ’কে অলিম্পিকের ইভেন্ট হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করেন। এমনকি বিচারকদেরকে ঘুষ দিয়ে রথ রেস প্রতিযোগিতার সময় পড়ে গিয়ে দৌড় শেষ করতে না পারলেও চ্যাম্পিয়নের মুকুট মাথায় পড়েন। এখানেই শেষ নয়, আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটও অলিম্পিককে ব্যবহার করে ছিলেন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। আলেকজান্ডার তাঁর নতুন সংবিধান প্রচারের জন্য বেছে নেন অলিম্পিককে।
আদি অলিম্পিক সংস্কৃতি : প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিককে ঘিরে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি মূলত ধর্মাশ্রীত ছিল। গ্রীক পুরাণ, হোমার, প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিকক নিদর্শন, সংগৃহীত লোককথা, পুঁথি, ঐতিহাসিকদের তথ্য-উপাত্তের নিরীক্ষে এটা খুবই পরিস্কার যে, গ্রীক জনগণের কাছে অলিম্পিক যতটা ছিল ক্রীড়া উৎসব, ততটাই ছিল ধর্মীয় ও শিল্পকলার উৎসব। গ্রীকরা অলিম্পাস পর্বতমালার পাদদেশ এ্যাথেনা নগরীকে রূপান্তরিত করেছিল তীর্থ ভ’মিতে। দেবরাজ জিউসের সম্মানার্থে গ্রীসের বিভিন্ন নগর-রাজ্যের অংশগ্রহণে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হত। প্রতিযোগীরা দেব-দেবীদের তুষ্ট করার নিমিত্তে নগ্ন হয়ে ক্রীড়াযজ্ঞে অংশ নিতেন। খেলার মাঝে একদিন জিউসের উদ্দেশ্যে ১০০টি ষাঁড়ের বলি দেয়া হত।
সময়ের সাথে সাথে অলিম্পিয়া গ্রীক প্যান্থিয়নের প্রধান জিউসের মুখ্য উপাসনাস্থল হয়ে ওঠে। ৪৩৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেবরাজ জিউসকে অমরত্ব দিতে গ্রীক স্থপতি লিবন অলিম্পাস পাহাড়ের উপরে একটি মন্দির গড়ে তোলেন। যা ছিল গ্রীসের সর্ববৃহৎ ডোরিক মন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম। মন্দিরের ভিতরে সোনা ও হাতির দাঁতের সমন্বয়ে সিংহাসনে বসা ৪২ ফুট (১৩ মি.) উঁচু জিউসের মূর্তি বানান ভাস্কর ফিডিয়াস। এই মূর্তি প্রাচীন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য্যের অন্যতম ছিল, যা আজ নেই।
ঐতিহাসিক স্ট্রাবো বলেন- উৎসবে জনসমাগম ও বিশ্বের শ্রেষ্ঠ খেলা অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য মন্দিরের গরিমা বজায় ছিল। অলিম্পিকে পুরস্কার হিসাবে পাতার মুকুট দেওয়া হলেও তা পবিত্র মানা হত। গ্রীসের সকল প্রান্ত থেকে আসা অর্ঘ্যে মন্দিরটি অলঙ্কৃত ছিল।
শৈল্পিক অভিব্যক্তি ছিল অলিম্পিকের অবিচ্ছেদ্দ অংশ। ফলে, ভাস্কর-কবি এবং অন্যান্য শিল্পীরা অলিম্পিকে এসে নিজেদের শিল্পকলার প্রদর্শন করতেন। এই সব ভাস্করদের সৃষ্ট কাজের মধ্যে মাইরনের ডিস্কোবোলাস বা ‘ডিস্কাস থ্রোয়ার’ উল্লেখযোগ্য। এই সব ভাস্কর্য্যের লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল, মানব শরীরের স্বাভাবিক সঞ্চালন ও শরীরে পেশির গঠন। অলিম্পিক বিজয়ীদের প্রশস্তিগাথা লেখার জন্য কবিদের সাহায্য নেওয়া হত। ‘এপিনিসিয়ান’ নামে পরিচিত এই কবিতাগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুখে মুখে ফিরত। অন্য যে কোনো সম্মানের থেকে অনেক বেশি কালোত্তীর্ণ হয়েছিল ‘এপিনিসিয়ান’। (আগামীকাল পড়ুন ৭ম পর্ব)