মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৪১ পূর্বাহ্ন

আদি অলিম্পিক ইতিকথা : পর্ব-৭

মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ
  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪
  • ৪৬ Time View

আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে ৭ম পর্ব।

(পূর্বে প্রকাশের পর)
আদি অলিম্পিকে রাজ্য ও রাজনীতির প্রভাব : মানব সভ্যতার উষালগ্নে প্রাচীন গ্রীস বিভক্ত ছিল অনেকগুলো স্বাধীন নগররাষ্ট্রে। উল্লেখযোগ্য নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ছিল- স্পার্টা, এথেন্স, ডেলফি, করিন্থ, থিবিস, আরগোস প্রভৃতি। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রীসের এই শহর-রাজ্যেগুলো একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করলেও দ্ব›দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত ছিল। রাজনৈতিক ও সামরিক জোটের কারণে যে প্রতিবেশীর উপর নির্ভরশীল ছিল, সম্পদ অর্জনে সেই একই প্রতিবেশীর সাথে তীব্রভাবে প্রতিদ্ব›দ্বীতায় জড়িয়ে ছিল। এমনই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদেরকে একত্রিত করেছিল ধর্মাশ্রীত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আদি অলিম্পিক।

অলিম্পিক চলাকালীন সকল অংশগ্রহণকারী নগর-রাজ্যের দ্বারা যুদ্ধবিরতি বা ‘ইকেচিরিয়া’ ঘোষণা করা হত। যাতে প্রতিযোগী এবং দর্শকরা নির্ভয়ে স্ব স্ব দেশ থেকে এসে অলিম্পিকে অংশ নিতে পারে। স্পন্দোফোরোই নামে পরিচিত তিনজন দৌড়বিদকে এলিসের পক্ষ থেকে গেমসে অংশ নেয়া শহরগুলিতে যুদ্ধবিরতি শুরুর ঘোষণা দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল। সে সময় সেনাবাহিনীকে অলিম্পিয়ায় প্রবেশ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আইনি বিরোধ এবং মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। খেলা চলাকালীন রাজনীতিকরা রাজনৈতিক মৈত্রীর কথা ঘোষণা করতেন, তেমনি যুদ্ধকালে পুরোহিতেরা ঈশ্বরের কাছে জয় কামনায় বলি চড়াতেন। ঐতিহাসিক থুসিডাইডসের লেখায় পাওয়া যায়- গেমস উপলক্ষে ইকেচিরিয়া চলাকালীন স্পার্টানরা লেপ্রিয়াম শহর আক্রমণ করায় তাদেরকে অলিম্পিকে নিষিদ্ধ এবং ২,০০০ মিনা জরিমানা করা হয়েছিল। স্পার্টানরা জরিমানা নিয়ে বিতর্ক করেছিল এবং দাবি করেছিল যে, যুদ্ধবিরতি এখনও শুরু হয়নি।

৫ম এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক উপনিবেশ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রেখেছিল বারবার সফল অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। অলিম্পিকের মাধ্যমে গ্রীক সংস্কৃতি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। আদি অলিম্পিক প্রাচীন গ্রীসে এবং তর্কযোগ্যভাবে প্রাচীন বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী ক্রীড়া ও সংস্কৃতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। অলিম্পিকসহ প্রাচীন গেমগুলি শহর-রাজ্যগুলির নিজেদের প্রচারের বাহন হয়ে উঠে।

কালক্রমে অলিম্পিক নগর-রাজ্যগুলির পরস্পরের ওপর ক্ষমতা জাহির করার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়। আর তাই অলিম্পিক গেমসের ভেন্যুর দখল নিতেও দেখা যায়। কারণ, ঐ স্থানের অধিকার মানে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উপর নিয়ন্ত্রণ এবং সেই সঙ্গে সম্মান ও রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেত। পসানিয়াসের লেখায় পাওয় যায়, ৬৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অলিম্পিয়ার উপাসনাস্থল ‘পিসা’ এলিসের কাছ থেকে দখল করার জন্য আর্গোসের ফিডনকে নিযুক্ত করেন ক্লিওস্থেনিস। তিনি সফল হন ও সে বছরের অলিম্পিক নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু, পরের বছরই এলিস অলিম্পিয়া পুনরুদ্ধার করে।

অপরদিকে অলিম্পিক বিজয়ীর সম্মানে যুদ্ধে সহায়তার নজিরও রয়েছে। ঐতিহাসিক পসানিয়াসের বর্ণনায় জানা যায়, স্পার্টানদের সমর্থনে ৬৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে থেরা’তে বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাইরিন’। তিনবারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন চিওনিসের ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে স্পার্টানরা তাদের সমর্থন দিয়েছিল। এইভাবে হেলেনিক সংস্কৃতি এবং গেমগুলি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভ’মিকা রেখে ছিল অলিম্পিয়া।

অলিম্পিকে নগ্নতা, গ্রীক-রোমান দ্বন্দ্ব : আদি অলিম্পিকে বেশিরভাগ ইভেন্টে ক্রীড়াবিদরা নগ্ন হয়ে অংশ নিতেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা প্রথার পক্ষে পন্ডিতরা ব্যাখা করে গেছেন। তত্ত¡গুলি উন্মাদনা থেকে শুরু করে সাধারণ নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ব্যাখ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পন্ডিতদের মতে- প্রথমত, নগ্নতা একটি আচার-অনুষ্ঠানের কথা বলে। দ্বিতীয়ত, নগ্নতা ছিল শিকার এবং জড়ো হওয়ার দিনগুলি থেকে নেয়া একটি ধারক। তৃতীয়ত, নগ্নতা গ্রীকদের জন্য ক্ষতি থেকে রক্ষা করার একটি যাদুকরী শক্তি ছিল এবং চতুর্থত, জনসাধারণের নগ্নতা ছিল উচ্চ শ্রেণির এক ধরণের পোশাক। দীর্ঘকাল ইহুদি এবং খ্রিস্টানদের আধিপত্যে থাকা সমাজে জনসমক্ষে নগ্ন হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা অদ্ভুত বলে প্রতিয়মনা হলেও প্রাচীন গ্রীকদের কাছে নগ্নতা বিশেষ করে পুরুষের নগ্নতা সম্পর্কে লজ্জাজনক কিছুই খুঁজে পায়নি।

আদি অলিম্পিকে গ্রীকদের কাছে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ছিল অ্যাথলেটিক্স। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে অংশ নিতেন। ক্রীড়াক্ষেত্রে নগ্নতার গ্রীক প্রথার প্রচলন করে স্পার্টা অথবা মেগারিয়ান ওর্সিপ্পাস ৭২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ এবং এটি দ্রুত অলিম্পিকেও প্রচলিত হয়। তবে নগ্নতা ইস্যুতে গ্রীকদের সাথে রোমানদের বিরোধ ছিল চড়মে। বিশেষ করে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি গ্রীক সা¤্রাজ্য যখন রোমান সা¤্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। গ্রীকদের কাছে অ্যাথলেটিক্স তুমুল জনপ্রিয় হলেও রোমানরা অবজ্ঞার সাথে দেখত। কারণ উলঙ্গ হয়ে জনসমক্ষে প্রতিযোগিতা করা তাদের চোখে অপমানজনক ছিল।

গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যে মনোভাবের প্রধান পার্থক্য প্রতিটি সাংস্কৃতি উৎসবে পরিলক্ষিত হতো। গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যে মনোভাবের প্রধান পার্থক্য প্রতিটি সাংস্কৃতি উৎসবে পরিলক্ষিত হতো। গ্রীকরা অ্যাথলেটিক্সে আর রোমানরা গø্যাডিয়েটর শো এবং দলের রথ দৌড়ে আগ্রহী ছিল। গ্রীকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল অ্যাগোনেস, পক্ষান্তরে রোমানদের কাছে লুডি।

গ্রীকরা মূলত প্রতিযোগীদের জন্য তাদের উৎসবের আয়োজন করত, আর রোমানরা জনসাধারণের জন্য। গ্রীকদেরটি ছিল প্রাথমিকভাবে প্রতিযোগিতা, রোমানদেরটা বিনোদন।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি গ্রীক সাম্রাজ্য রোমের অধীনস্থ হবার পর অলিম্পিক সহ অন্যান্য প্রতিযোগিতায় রাষ্ট্রীয় সমর্থন পরবর্তী শতাব্দীতে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

তা সত্তে¡ও রোমানরা গ্রীক উৎসবগুলির রাজনৈতিক মূল্য উপলব্ধি করেছিল এবং সম্রাট অগাস্টাস রোমের সার্কাস ম্যাক্সিমাসের কাছে নির্মিত একটি অস্থায়ী কাঠের স্টেডিয়ামে গ্রীক ক্রীড়াবিদদের জন্য খেলার মঞ্চায়ন করেছিলেন। এছাড়াও ইতালি এবং গ্রীসে বড় পরিসরে নতুন ‘অ্যাথলেটিক উৎসব’ আয়োজন করেছিলেন। সম্রাট নিরোও গ্রীসের উৎসবগুলির একজন অগ্রগণ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। (আগামীকাল পড়ুন ৮ম পর্ব)

আপডেট সংবাদ পেতে শতাব্দীর কন্ঠ পড়ুন, শেয়ার করে সাথে থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
All rights reserved © Shatabdir Kantha . Developed by SDTT Academy & Tech Liberty