আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে শেষ পর্ব।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
অলিম্পিকে হিংসতা ও ভয়াবহতা : আদি অলিম্পিক গ্রীক সা¤্রাজ্যে কেবল শান্তির ডালা নিয়েই হাজির হতো না, যুদ্ধের বিভিষিকাতেও থাকত নিমজ্জিত। নগ্নতা, ঘুষ-দুর্নীতি, রাজনৈতিক কুপ্রভাব ছাড়াও একে প্রচন্ড ভাবে গ্রাস করে ছিল অবর্ণনীয় বিভৎসতা। পাশাপাশি কয়েকটি লোমহর্ষক ইভেন্ট গেমসের মহিমাকে করে ছিল আহত। সে সময় মুষ্টিযোদ্ধারা প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্ব›দ্বীকে ধরাশায়ী করতে হাতের মুষ্টি এবং কুনুয়ের ওপর পর্যন্ত চামড়া প্যাচিয়ে তার নিচে ধাতব প্লেট বা ধারাল নখ ব্যবহার করত। যার দরুন আহত হবার ঘটনা প্রায়ই ঘটত। মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে একাধিক।
মুষ্টিযুদ্ধের চেয়েও বিভৎস ছিল প্যানক্রাশন ইভেন্টটি। যা ছিল আদি অলিম্পিকের সর্বাপেক্ষা নৃশংস প্রতিযোগিতা। এই ইভেন্টে পরাজিতকে বরণ করতে হতো বাধ্যতামূলক মৃত্যুদÐ। এমনকি বিজয়ীকেও মৃত্যুবরণ করার মতো ঘটনা ঘটেছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৫৬ সালে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে ফিগালিয়ার ‘আরকিডন’ বিজয়ী হবার পরও ভাগ্যে জুটে ছিল করুণ মৃত্যু। প্রতিপক্ষের আঘাতে আহত আরকিডন পুরস্কার গ্রহণের সময় মৃত্যুরকোলে ঢলে পড়েন। প্যানক্রেশনে অংশ নেয়া প্রতিযোগীরা একে অন্যের হাত-পা ভেঙে দিত, লাথি মারত, এমনকি গলা চেপে ধরতেও পারতেন।
এখানেই থেমে থাকত না আদি অলিম্পিকের নৃশংসতা, ভয়াবহতা। গেমসের আকর্ষণ এবং নিখাদ বিনোদনের জন্য আয়োজন করা হতো আদি মানব জাতির সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুরতম ও মানবতা বিরোধী প্রতিযোগিতা ‘স্লেভ এন্ড বিষ্ট ফাইট’। রোমানদের কাছে যা ছিল তুমুল জনপ্রিয়। একটি প্রকোষ্টের মধ্যে ক্ষুধার্ত সিংহ বা বাঘকে ছেড়ে দিয়ে ওপর থেকে বিশেষ কৌশলে নিক্ষেপ করত একজন ক্রীতদাসকে। সেই ক্রীতদাস বাঁচার জন্য প্রাণ পণে লড়াই করে যেত হিংস্র পশুর বিরুদ্ধে। এক সময় হিংস্র পশুটি ক্রীতদাসের হাত-পা, মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলত এবং ধীরে ধীরে ক্রীতদাসের ছিন্ন-ভিন্ন দেহটি নিথর পড়ে থাকত। আর তা দেখেই উপস্থিত লোকেরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠত। দর্শক প্রিয়তার কারণে রোমানরা ক্রীতদাস আর পশুর মধ্যকার লড়াইকে পরিণত করে ফেলে ফ্যাশনে।
আদি অলিম্পিকের অপমৃত্যু : প্রাচীন ক্রীড়াযজ্ঞটি প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত। এতে মূলত বিভিন্ন ধরনের দৌড় প্রতিযোগিতা হত। বিজয়ীর মাথায় পরিয়ে দেয়া হত লরেল পাতার মুকুট। কালক্রমে যুক্ত হতে থাকে নানা ইভেন্ট ও নৃশংসতা। তথাপি, প্রাচীন ও আধুনিক অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে একটি মিল এখনও বিদ্যমান। আর তা হচ্ছে বিজয়ী প্রতিযোগিরা আজও সমধিক সম্মানিত, প্রসংশিত ও সম্বর্ধিত। তাদের কীর্তি ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও নথিবদ্ধ হয় যাতে আগামী প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে পারে।
আদি অলিম্পিয়াডের সূচনা লগ্ন থেকে পরবর্তী দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গেমসের প্রকৃত রূপরস বিদ্যমান থাকায় অলিম্পিকের খ্যাতি ভ’মধ্যসাগর ছাড়িয়ে এক সময় ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। গেসমের বয়স ও ব্যাপ্তি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ঘুষ-দুর্নীতি, অনাচার আর নৃশংসতা। সৌন্দর্যের আর শান্তির অলিম্পিয়াড ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হতে থাকে কুলষতা আর যুদ্ধের দামামায়। যতো দূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ৩২০তম অলিম্পিকই ছিল আদি অলিম্পিকের সর্বশেষ আসর।
টানা প্রায় ১৩শ’ বছর চলার পর রোমান সম্রাট প্রথম থিওডিয়াস অথবা তার পুত্র অলিম্পিক উৎসবে পৌত্তলিকতার আধিক্কের কারণে এবং খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে ৩৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক আইনের বলে বন্ধ করে দেন আদি অলিম্পিক গেমস। ৩৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্বর এলারিকদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায় অলিম্পিক স্টেডিয়াম ও এর আশপাশের এলাকা। তারপর বেশ কয়েকটি বড় ধরনের ভ’মিকম্প আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি অলিম্পিককে। সেই সাথে অপমৃত্যু ঘটে বর্ণাঢ্য আদি অলিম্পিকের।
অবশ্য দীর্ঘকাল অলিম্পিক বন্ধ থাকার পর স্পার্টার লাইকার্গুস, এলিসের ইফিটোস এবং পিসার ক্লিওস্থেনিস ডেল্ফির ওরাকলের আদেশে প্রাচীন অলিম্পিকের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ডেল্ফির ওরাকলের মতে- মানুষ ঈশ্বর বিমুখ হয়ে পড়েছে, ফলে মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছে ও অনবরত যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই রয়েছে। অলিম্পিক নতুন করে শুরু করলে মহামারী শেষ হবে, শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং মানুষ আবার সাধারণ প্রথাগত জীবনধারায় ফিরে যাবে। তবে দ্বিতীয় পর্বে আদি অলিম্পিক খুব সম্ভবত খ্রিস্টবর্ষের দ্বিতীয় শতকের কোন এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। (সমাপ্ত)