আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে ২য় পর্ব।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি’ থেকে : পৃথিবীর প্রাচীনতম এবং আদি অলিম্পিকের সমসাময়িক মহাকবি (দৃষ্টিহীন) হোমার রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ইলিয়াড ও ওডিসি’তে প্রাচীন অলিম্পিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইলিয়াড থেকে জানা যায়, গ্রীক বীর একিলিস তার বন্ধু পেট্রোক্লাসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে খেলাধূলার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল- রথ দৌড়, খালি পায়ে দৌড়, মুষ্টিযুদ্ধ এবং ডিস্কাস থ্রো।
হোমারের ‘ওডিসি’ থেকে জানা যায়, গ্রীসের উত্তরাঞ্চলের ঈজিয়ান সাগরের তীরে ম্যাসিডোনিয়া ও থেসালির সীমান্তে অবস্থিত বিস্তৃত পর্বত শ্রেণির শীর্ষ দেশ Mount Olympus হচ্ছে দেবতাদের স্বর্গরাজ্য এবং দেবরাজ জিউস ও দেব পরিবারের দেবদেবীর অধিষ্ঠান। সেখানে রয়েছে সুদৃশ্য প্রাসাদ। দেবরাজ জিউসের প্রাসাদে দেবদেবীগণ দিবাভাগে নৃত্যগীত ও আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকেন। দেবতাদের এই রাজ্য মেঘের দেয়ালে ঘেরা এবং সময় হল এই রাজ্যের প্রবেশ দ্বার।
এই অলিম্পাস পর্বতের উপত্যকায় জিউসের ৪০ ফুট উচু মূর্তিকে কেন্দ্র করে প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হতো দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য পূঁজোর। পূঁজোর উৎসবে দেশ-বিদেশ থেকে আসত জ্ঞানী-গুণী, সৌম্যকান্তি লবিষ্ঠ দেহের খেলোয়াড়ের দল। উৎসবের অঙ্গ হিসেবে অনুষ্ঠিত হত বিশাল ক্রীড়াযজ্ঞের।
হোমারের সাহিত্য থেকে আদি অলিম্পিকের মর্মোদ্ধার করা যায়। তাঁর বর্ণনা থেকে একজন খেলোয়াড়ের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে ছাপিয়ে সেরা হবার বাসনা এবং সেই চেষ্টার আনন্দকে উপলব্ধি করা যায়। হোমার প্রাচীন গ্রিক মূল্যবোধ ও অভিজাত সৌজন্যবোধের সমর্থক ছিলেন। তার কাছে খেলা নিছক কোনো খেলা ছিল না। তাঁর মতে, খেলার প্রতিযোগিতা ছিল শৌর্য্যের পরিচয় দেবার মাধ্যম। আর প্রতিযোগিতা শেষে জয় লাভ ও পুরস্কার বিতরণ হল প্রতিযোগী ও আয়োজকের শৌর্য্যের দ্যোতক।
তথাপি কখনো কখনো নায়কেরা প্রতিযোগিতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করতেন বা এড়িয়ে যেতেন। প্রতিদ্বন্দ্বীতা না করা বা আমন্ত্রণ সত্তে¡ও নিজের শৌর্য্য প্রদর্শণ না করা খুবই অস্বাভাবিক ছিল। একে স্বেচ্ছায় নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেবার সমতুল্য মনে করা হত। তবে, প্রতিদ্বন্দ্বীতা না করলে তার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেয়া বাধ্যতামূলক ছিল।
একিলিস আয়োজিত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়েছিল যুদ্ধে লুট করা মালামাল। যেমন কোনো বিজিত শত্রুর বর্ম। খেলাধূলার পুরস্কারের ঘোষণা বা বিতরণের বর্ণনা দিয়ে হোমার লিখেছেন- উপহার প্রদান প্রাচীন প্রথা অনুসারেই করা হতো। মৃত কোনো ব্যক্তির সম্পত্তি, নতুন সম্পর্কের সূচনা বা কোনো সম্পর্কের নবীকরণ পুরস্কার হিসাবে গণ্য হত।
প্রাচীন ঐতিহাসিকদের মতে আদি অলিম্পিক : গ্রিক ঐতিহাসিক পসানিয়াসের লেখা থেকে জানা যায়, ডাক্টাইল হেরাক্লিস তার দুই ভাইয়ের সাথে অলিম্পিয়ায় এক দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। তিনি বিজয়ীকে লরেল পাতার মুকুট পরান। সেই থেকে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের পুরস্কার হিসাবে লরেল পাতার মুকুটের প্রথার প্রচলন হয়। অন্যান্য দেব-দেবীরাও কুস্তি, লাফানো, দৌড়ানো ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশ নিতেন।
ঐতিহাসিক পিন্ডার মতে, অলিম্পিয়া উৎসবের সূচনা হয় অলিম্পিয়ার রাজা ও পেলোপোনেসাসের স্বনামধন্য বীর পেলোপ্স এবং জিউসের পুত্র হেরাক্লিস বা হারকিউলিসের মাধ্যমে। হেরাক্লিস তার পিতার সম্মানার্থে এক দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। পেলোপ্স পসেইডনের সাহায্যে চালাকি করে স্থানীয় এক রাজাকে রথ দৌড়ে পরাস্ত করেন এবং জয়ের পুরস্কার হিসাবে রাজকন্যা হিপ্পোডামিয়াকে দাবি করে বসেন।
আধুনিক ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের মতে : আজকের জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত মানব জাতি শুধু লোককথা আর পুরাণে বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে কোন কিছুর অস্তিত্বকে মেনে নিতে রাজি নয়। তাই সর্বোচ্চ প্রয়াস চালিয়ে যে সব তথ্য-উপাত্ত আর প্রমাণাদী উদ্ধার করা গেছে সেগুলোর সমন্বয় ঘটিয়ে যে ইতিহাস আবিষ্কার করেছে তা অন্য রকম। গ্রীসের এখানে সেখানে খুঁড়া-খুঁড়ি করে নৃতত্ত¡বিদরা যে সব পুরাকীর্তি পেয়েছেন এবং সে সময়কার তৈজসপত্রে গ্রীক শিল্পীদের আঁকা চিত্রকর্মের সূত্রধরে, আর তার সাথে প্রাপ্ত পুরনো পুঁথিপত্র যোগ করে মোটামুটি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন।
সে অনুসারে গ্রীক দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে এলিস রাজা ইফোটাস এক আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পাঁচদিন ব্যাপী এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়ে ছিলেন ইফোটাস। তখনকার গ্রীক রাজ্যগুলো ছিল নগর কেন্দ্রীক, আর প্রতিবেশী এসব রাজা-রাজদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত। এসবের ইতি টানতে ইফোটাস এই সম্মেলনের আয়োজন করেন।
অলিম্পিয়া পর্বতের পাদদেশে সে সম্মেলনে উপস্থিত রাজারা এক শান্তি সনদে স্বাক্ষর করেন। সনদের মূল বিষয় ছিল প্রতি চার বছর অন্তর নগর রাষ্ট্রগুলোর সেরা ক্রীড়াবিদদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সেরা ক্রীড়া উৎসব এবং সে সময় যুদ্ধ হবে না। প্রতিযোগিতা শুরু হবার এক মাস আগে থেকেই গ্রীক সীমান্ত রাজারা এক চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতেন যাতে প্রতিযোগীরা নিরাপদে অলিম্পিয়া নগরিতে পৌছতে পারে। যারা এর অন্যথা করতেন তাদেরকে জরিমানা এবং সে রাজ্যের অ্যাথলেটদের নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার ছিল বিচারকদের।
প্রাচীন গ্রীকদের ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্রে সেই সময়ের খেলাধুলার নানান চিত্র আর নিয়ম কানুনের কথা জানতে পরেছেন প্রতœতত্ত¡বিদরা। ডিস্কাসের টুকরো, জেভলিনের ফলা আর নানা ধাতব প্লেটের মধ্যে স্থির হয়ে আছে আদি অলিম্পিকের ইতিহাস। গ্রীক চিত্রকলার কল্যাণে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে পাওয়া ঐ সমস্ত তৈজসপত্রে নাক ভাঙা মুষ্টিযোদ্ধা, কেটে যাওয়া উড়ন্ত হাত, পড়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত অ্যাথলেটের চিত্র সহজেই জানান দেয় সে সময়কার প্রতিযোগিতার।
(আগামীকাল পড়ুন ৩য় পর্ব)