আজ থেকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে নিছক দেবদেবীদের সন্তুষ্টির নিমিত্তে গ্রীসের অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনা নগরীতে যে ক্রীড়াযজ্ঞের সূচনা হয় তাই আদি বা প্রাচীন অলিম্পিক নামে খ্যাত। অনেক চড়াই-উত্থরাই পেরিয়ে টানা ১৩শ’ বছর নানা ঘটন-অঘটনের জন্মা দেয়া ক্রীড়াযজ্ঞ নিয়ে আমাদের এই বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজন.. আজ থাকছে ৩য় পর্ব।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
স্থান নির্বাচনের নেপথ্য, বিচারক ও পুরষ্কার : আদি অলিম্পিকের ভেন্যু হিসেবে অলিম্পিয়া বা এ্যাথেনী নগরকে বেছে নেয়ার নেপথ্যে কাজ করেছে নগরীর প্রাচীনত্ব, গ্রীসের অপরাপর তীর্থ ভ’মি থেকে এর স্বাতন্ত্রতা। কারণ, রানি মাতা দেবী হেরার মন্দির, দেবরাজ জিউসের সুউচ্চ মূর্তি ও মন্দির, জ্ঞানেশ্বরী এ্যাথিনী, সমুদ্র দেবতা পোসাইডন ছাড়াও বহু দেবদেবীর মন্দির শোভিত ছিল এ্যাথিনী বা এথেন্স।
এ ছাড়া যোগাযোগের দিক থেকেও এ নগরী ছিল সবচেয়ে সুবিধাজনক। এখানে জাহাজেও পৌঁছানো যেত। যে কোন গ্রীক নাগরিকই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। কিন্তু, বিচারকের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা ছিল শুধুমাত্র এলিসের নাগরিকদের, যা ছিল অলিম্পিয়ারই একটি অঞ্চল। নিরপেক্ষতা ও সচ্চরিত্রের জন্য ভীষণ খ্যাতি ছিল তাদের। যে কারণে এলিসের লোকেরাও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত।
অলিম্পিকের নামকরণের পেছনেও রয়েছে আরেক কিংবদন্তির গল্প। হেরিক্লাস ছিল সে সময়ের সেরা ¯্রন্টিার। তো খ্যাতিমান এই অ্যাথলেট প্রস্তাব দেন, প্রতিযোগিতা হবে ‘পেন্টোটিরিকস’ অর্থ্যাৎ পঞ্চম বছরের শুরুতে চার বছর পর পর। গেমস এবং একে ঘিরে উৎসবের নাম দেন ‘অলিম্পিক’। তারকা খ্যাতির কারণেই তার কথা মেনে নেন সবাই।
এই ক্রীড়াযজ্ঞে অংশ নিয়ে বিজয়ীরা আজকের মতো স্বর্ণের পদক বা অর্থ কোনটাই পেতেন না। বিজয়ীকে দেয়া হতো পবিত্র অলিভ বা জলপাই গাছের পাতার মুকুট ও স্তবক এবং অলিম্পিয়াতে নিজের আবক্ষ মূর্তি স্থাপনের অনুমতি। অবশ্য বিজয়ীরা নিজ দেশের সরকার থেকে পেতেন বার্ষিক বৃত্তি ও নিজ নগরে পেতেন বীরের মর্যাদা। তাছাড়া নাগরিক উৎসবগুলোতে সবার সামনে বসা, বিনে পয়সায় খাবার খাওয়ার সুবিধা। এমনকি যৌনসঙ্গীও পেতেন। এক কথায় মানুষ হয়েও পেতেন দেবতার সম্মান।
অলিম্পিক শুরুর ক্ষণ নিয়ে বিতর্ক : ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর ঐতিহাসিক ইফোরাস বর্ষগণনার একক হিসাবে অলিম্পিয়াডের প্রথম ব্যবহার করেন। অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত, ফলে পরবর্তিকালে অলিম্পিয়াড ও অলিম্পিক সমার্থক হয়ে পড়ে। অলিম্পিয়াড বলতে পরপর দুটি অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যবর্তী সময়কে বোঝায়।
আগে প্রতিটি গ্রিক নগররাষ্ট্রের নিজস্ব দিন গণনার পদ্ধতি ছিল যা স্থানীয় ভাবে ব্যবহৃত হত। ফলে তারিখ নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তির সৃষ্টি হত। যেমন- ডিওডোরাসের লেখায় পাওয়া যায়, ১১৩তম অলিম্পিয়াডের তৃতীয় বর্ষে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। এটি নিশ্চয়ই ৩১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রহণ। আর তা যদি হয় তাহলে প্রথম অলিম্পিয়াডের প্রথম বর্ষের সময়কাল হচ্ছে ৭৬৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি। তা সত্তে¡ও, অলিম্পিকের শুরুর সময়কাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য বিদ্যমান।
ইতিহাসের মলিন পাতা আর দলিলাদী ঘেঁটে আধুনিক ইতিহাসবিদ ও গবেষকগণ অলিম্পিকের প্রথম যে রেকর্ড পেয়েছেন তা যীশুর জন্মের ৭৭৬ বছর আগের। তবে ধারণা করা হয় আদি অলিম্পিকের প্রথম আসরটি বসে ছিল খ্রিস্টপূর্ব ১৩৭০ সালে। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে গ্রীসে অন্তত চারটি ‘ধ্রুপদী ক্রীড়া’ প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল।
সেগুলো হল- ডেলফিতে পাইথিয়ান গেমস, নেমিয়াতে নেমিয়ান গেমস এবং করিন্থের কাছে ইস্তামিয়ান গেমস। তবে সেগুলোর মধে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল অলিম্পিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস। পরবর্তীতে রোম, নেপলস, ওডেসাস, অ্যান্টিওক এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মতো প্রায় ১৫০টি শহরে অনুরূপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৬ আগস্ট থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে মূলত বিভিন্ন ধরনের দৌড় প্রতিযোগিতা হত। বিজয়ীর মাথায় পরিয়ে দেয়া হত লরেল পাতার মুকুট। অলিম্পিকের শুরুতে শুধুমাত্র স্বাধীন গ্রীকভাষী পুরুষই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। তবে সময়ের সাথে সাথে প্রাচীন নগর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিযোগীরা অলিম্পিকে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়ে ছিলেন।
১৭৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রীক পর্যটক পসানিয়াস লেখেন, সে যুগে একমাত্র প্রতিযোগিতা ছিল ‘স্ট্যাডিয়ান’। যেখানে প্রতিযোগীরা হারকিউলিসের পায়ের সমান ১৯০ মিটার বা ৬২০ ফুট দূরত্বের কিছু বেশি দৌড়াত। স্টেডিয়াম কথাটি এই প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত।
তবে অনান্য ঐতিহাসিকগণের মতে- সে যুগে প্রচলিত চারটি প্যানহেলেনিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে অন্যতম ছিল আদি অলিম্পিক। প্রতিযোগিতাগুলো দুই থেকে চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হত। সময় এমনভাবে ফেলা হত যাতে প্রতি বছর অন্তত একটা খেলা থাকে। তবে পাইথিয়ান, নিমিয়ান ও ইস্থমিয়ান ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে অলিম্পিক ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত।
আদি কলা-কানুন ও স্টেডিয়াম : ধারনা করা হয় ‘স্টেড রেস’ থেকে স্টেডিয়াম নামের উৎপত্তি। সে সময় গেমসের কলা-কানুনে যেমন ভিন্নতা ছিল, তেমনি আদি অলিম্পিক স্টেডিয়ামেও ছিল ভিন্নতা। এখনকার মতো ট্র্যাকগুলো তখন চক্রাকারে ছিল না। লম্বা-লম্বি ট্র্যাকের দূরত্ব ছিল ২০০ মিটার। অ্যাথলেটরা সোজা দৌড়ে এক প্রান্তে পৌঁছার পর আবার ফিরে আসত। কখনো কখনো ১৫ বারও দৌড়াতে হতো প্রতিযোগীদেরকে। ট্র্যাকের স্টার্টিং পয়েন্টে ছিল পাথরের ব্লক। ব্লকে ছিল পায়ের আঙ্গুল রাখার জন্য নির্দিষ্ট ছাপ।
দৌড় শুরুর পূর্বে প্রতিযোগীরা স্টার্টিং পয়েন্টে অবস্থান নিত, আর এক বিচারকের হাতে থাকত একটা টানা দড়ি। দড়ির অন্য প্রান্তে ওপরে ঝুলানো থাকত উন্মুক্ত একটা দরজা। বাজনা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দড়ি ছেড়ে দিতেন বিচারক। সশব্দে নিচে নেমে এসে দরজাটি বন্ধ হয়ে যেত, আর প্রতিযোগীরা শুরু করত দৌড়। দরজা বন্ধ হবার আগে কোন অ্যাথলেট দৌড় শুরু করলে জুটত বিচারকের চাবুক।
প্রিন্টারদের জন্য ছিল লকার রুম। সেখানে প্রস্তুতি নিয়ে টানেল ধরে প্রতিযোগীরা এসে দাঁড়ত ট্র্যাকে, হাজার হাজার দর্শকের সম্মুখে তাদের শ্রেষ্ঠত প্রদর্শনের জন্য। প্রাথমিক বাছায়ে উত্তীর্ণরাই কেবল পুরুষ ও বালক বিভাগে বিভক্ত হয়ে অংশ নিত স্টেড রেসে। রেসে বিজয়ী ক্রীড়াবিদকে দিয়ে জ্বালানো হত অলিম্পিক মশাল। দেবী হেরার মন্দিরে পুরোহিতদের সহায়তায় প্রজ্জ্বলন করা হত গেমসের মশাল।
শুরুর দিকে শুধুমাত্র স্বাধীন গ্রীকভাষী পুরুষই এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারত। যদিও বিলিস্টিচ নামে এক মহিলা বিজয়ীর নাম নথিভুক্ত পাওয়া যায়। অনেক গ্রীক প্রতিযোগী ইতালীয় উপদ্বীপ, এশিয়া মাইনর এবং আফ্রিকার গ্রীক উপনিবেশ থেকে এসেছিল। অবশ্য পরবর্তীতে মেসিডোনিয়ান সৈন্যরা গ্রিস দখল করে নিলে পরিবর্তন আসে এ নিয়মে।
আদি অলিম্পিকের ব্যাপ্তিকাল সম্পর্কে যত দূর জানা যায় তাতে- ৬৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অনুষ্ঠিত ২২তম অলিম্পিক পর্যন্ত প্রতিযোগিতার সময়সীমা এক দিনে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা বেড়ে পাঁচ দিনে দাঁড়ায় ৩৭তম আসরে ৬৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সে সময়ও এখনকার মতো প্রতিযোগীদের জন্য গেমস ভিলেজ ছিল। প্রতিযোগিতা শুরুর এক মাস আগে অলিম্পিক নগরীর কোন এক স্থানে প্রতিযোগীরা সমবেত হয়ে অনুশীল করতেন। সে সময় গ্রীক নগর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে গেমস উপলক্ষে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হত।
(আগামীকাল পড়ুন ৪র্থ পর্ব)