মো. নজরুল ইসলাম, স্টাফ রিপোর্টার (অষ্টগ্রাম) কিশোরগঞ্জ : বর্ষার পানিতে বিস্তীর্ণ হাওর তলিয়ে গেলে নদী-নালা, খাল-বিল অথৈ জলরাশিতে সব একাকার হয়ে যায়। এক সময় এই হাওরের বুকে ঢেউয়ের কলধ্বনীতে শত শত জেলের পাল তুলা নৌকা হাওরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিত। কিন্তু প্রভাবশালী ইজারাদারদের আগ্রাসী ভ‚মিকায় হাওরের এই সৌন্দর্য এখন আর খুব একটা চোখে পড়েনা।
বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল তলিয়ে গেলে ইজারাদারেরা তাদের সীমানা ছাড়িয়ে বিশাল হাওরও দখল করে নেয়। তাদের প্রভাব ও দখলদারিত্বে জেলে ও দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায় তাদের নিজ জমিতেও মাছ ধরতে সাহস পায়না। মাছ ধরতে গেলেই তাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে টাকা। টাকা না দিলেই তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে জলাশয় থেকে। ভয় দেখানো হচ্ছে হামলা ও মামলার।
কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা অষ্টগ্রামে প্রায় আট হাজার জেলে পরিবারের বাস। বর্ষায় হাওরে বিকল্প কোন কাজ না থাকায় এই বৃহৎ জেলে গোষ্টীসহ হতদরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান পেশা হচ্ছে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। সূত্র জানায়, ইজারাদারদের দখলদারিত্বে হাওরের খোলা পানিতে স্রোতস্বিনী চলমান নদীর কোথাও সাধারণ জেলে বা হতদরিদ্র কৃষকেরা মাছ ধরার অধিকার পাচ্ছেনা। আবার এ বিষয়ে প্রশাসনকে জানিয়েও তাদের কোন লাভ হচ্ছেনা। ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে তাদের জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনের বিভিন্ন হাওর ঘুরে এ চিত্রই চোখে পড়ে। এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় জেলে ও কৃষকদের সাথে। তাদের প্রতিনিধি সাইফুল, জুয়েল, মোহাম্মদ আলী ও আজিজুল জানায়, আমাদের ঘরে খাবার নেই। হাওরে মাছ ধরতে গেলে ইজারাদারের লোকজন আমাদের বাধাদেন। ভয়ভীতি দেখান। তাদের ভয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব জমিতেও মাছ ধরতে পারিনা। গত বছর মাছ ধরতে গিয়ে আমাদের অনেককে আহত হতে হয়েছে। এবারও তাদের টাকা না দিয়ে আমরা নিজের জমিসহ হাওরের কোথাও মাছ ধরতে পারছিনা। টাকা না দিলেই আমাদের মামলা ও হামলার ভয় দেখানো হচ্ছে।
অবশ্য এমদাদুল হক খোকন নামে এক ইজারাদার জেলে ও কৃষকদের এ অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন। তিনি বলেন, আমরা কোন জেলে ও কৃষককে উম্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরতে বাধা দেইনি।
এবিষয়ে হাওর অঞ্চলবাসী ঢাকার সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বাবু এ প্রতিনিধিকে জানান, এমন ইজারা থেকে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ খুবই সামান্য, ক্ষমতাবান দল ও প্রশাসনিক কর্তাদের অবৈধ আর্থিক সুবিধা বেশি। ইজারা প্রথা অবশ্যই বাতিল হওয়া উচিত, এ প্রথা প্রকৃত জেলে ও মৎস্য জীবিদের জীবন জীবিকা হুমকির মুখে ফেলেছে। ভাসান পানীর মাছ ধরা জেলেদের আইনগত অধিকার, এখানে বাধা দেয়া আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।
এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন মুকুল এ প্রতিনিধিকে জানান, ইজারাকৃত নদীতে মাছ ধরা যেমন ইজারাদারের অধিকার, তেমনি উম্মুক্ত পানিতে মাছ ধরাও জেলে ও কৃষকদের অধিকার। কারও অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। আমি আমাদের দলের সকল নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশ প্রদান করেছি।
হাওর অঞ্চলবাসী’র প্রধান সমন্বয়ক ড. হালিমদাদ খাঁন মুঠোফোনে এ প্রতিনিধিকে জানান, উম্মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরা জেলে ও কৃষকদের অধিকার। এ অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ বেআইনী। জেলে ও কৃষকদের স্বার্থে ইজারা প্রথা উঠিয়ে দিয়ে ’জল যার জলা তার’ দ্রæত এ নীতির বাস্তবায়ন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার দিলশাদ জাহান এ প্রতিনিধিকে জানান, উম্মুক্ত জলাশয়ে জেলেদের মাছ ধরতে নিষেধ দেওয়া অধিকার কারও নেই। কেউ বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খাঁন এ প্রতিনিধিকে জানান, আমি এখানে নতুন এসেছি, বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে না জানা পর্যন্ত তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।