কৃষি প্রতিবেদক, বিপুল মেহেদী : ধান উৎপাদনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কৃষি নির্ভর। ধানের উৎপাদনশীলতা ও গুণমান বজায় রাখতে কৃষকদের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ক্ষতিকর বাদামী গাছ ফড়িং (Brown Plant hopper) ধান গাছের জন্য অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক বালাই। ‘বাদামি গাছ ফড়িং’- কারেন্ট পোকা অথবা গুনগুণি পোকা নামেও পরিচিত। একে BPH বা Brown Plant Hopper বলা হয়ে থাকে। এটি বাদামি রঙ্গের খুবই ছোট আকৃতির পোকা প্রায় ৪ মি.মি. লম্বা। তবে বাচ্চা অবস্থায় প্রথমত সাদা হয়ে থাকে। পোকাটি মূলত ধান গাছের গোড়ায় বা খোলে দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। বাচ্চা থেকে পূর্ণবয়স্ক হতে ৫ বার খোলশ পরিবর্তন করে, তাই গাছের গোড়ায় মৃত খোলশও দেখা যায়।
বাতাস চলাচল করে না এমন ছায়া জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। যে স্থানে ধান গাছ হেলে পড়ে সেখানেও এদের উপস্থিতি বেশি দেখা যায়। অনুকূল পরিবেশে খুব দ্রæত বংশ বিস্তার করে। এক জোড়া পোকা একবারে লক্ষাধিক পোকার জন্ম দেয়। স্যাঁতস্যাঁতে ও ছায়াযুক্ত, আদ্র ও গরম ‘গুমট’ অবস্থায় অথবা পানি জমে আছে এমন জমিতে দ্রæত বংশবিস্তার করে।
অতিরিক্ত ইউরিয়া সারের প্রয়োগ, কুশি বেশি নেয় এমন জাত অথবা ঘন গাছ অনুকূল পরিবেশ। ডিম থেকে ৭-৯ দিনে বাচ্চা হয় এবং সেটি ১৩-১৫ দিনে পূর্ণবয়স্ক পোকায় পরিণত হয়। বাচ্চা এবং পূর্ণবয়স্ক উভয় অবস্থায় ক্ষতি করে থাকে।
ধানের জমিতে যেকোন সময় আক্রমণ করতে পারে, তবে কাইচথোর বের হওয়ার সময় থেকেই এদের আক্রমণ বেশি লক্ষ্য করা যায়। ধান গাছের গোড়ায় দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করে, দৈনিক তাদের শরীরের ওজনের ১০-২০ গুণ পর্যন্ত রস শোষণ করতে পারে। বাদামি গাছ ফড়িং মুখের ধারালো অংশ ব্যবহার করে ধানের গাছের নরম অংশে আক্রমণ করে এবং গাছের জাইলেম ও ফ্লোয়েম (xylem and phloem) থেকে রস চুষে নেয়।
রস চুষে খাওয়ার ফলে গাছের পুষ্টি ও পানি পরিবহণ বাধাগ্রস্ত হয়। চুষে খাওয়ার সময় ক্ষুদ্র পরিমাণে ফিটোটক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে, যা কোষের শ্বাসক্রিয়া ও পুষ্টি গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে।
কোষগুলো প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপকতা হারায় ফলে ধানের গাছের পাতা সাদা বা হলদে হয়ে মরে যায়, যা ‘হপারবার্ন’ নামে পরিচিত। মূলত হপারবার্নের সময় ধানগাছ পুষ্টির অভাব ও কোষ ধ্বংসের কারণে গাছ দুর্বল, হলুদ হয়ে যায়, পরে গাছ শুকিয়ে মারা যায়। ধানের ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাদামী গাছ ফড়িং গ্রাসি স্টান্ট, ব্যাগেট স্টান্ট ও উইল্টেড স্টান্ট নামক ভাইরাস রোগ ছড়ায়। খুব তাড়াতাড়ি বংশবৃদ্ধি করায় এদের সংখ্যা এতো বেড়ে যায় যে আক্রান্ত জমি বাজ পড়ার মতো হপারবার্ণ এর সৃষ্টি হয়। আক্রমণে মাঠের পর মাঠ ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ২০% থেকে ১০০% পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিরোধী আগাম জাতের ধান রোপন করে এর ক্ষতি থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়াও যা যা করতে হবে…
১. জমির আইল পরিস্কার রাখতে হবে। সঠিক দূরত্বে চারা রোপন করতে হবে (ঘন রোপন করা যাবে না)।
২. আক্রান্ত জমির পানি সরিয়ে ৭-৮ দিন মাটি শুকনো রাখতে হবে।
৩. ইউরিয়া সার বেশি প্রয়োগ করা যাবে না। সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
৪. আক্রান্ত জমিতে ২-৩ হাত দূরে দূরে ‘বিলিকেটে’ সূর্যের আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে (ওসমানি কায়দায়) দ্রুত বালাইনাশক স্প্রে করতে হবে।
ঔ= সঠিক ঔষধ স=সঠিক সময়ে মা=সঠিক মাত্রায় নি=সঠিক নিয়মে
সাধারণত আক্রমণ মাঝারি হলে পাইমেট্রোজিন গ্রুপের বালাইনাষক ব্যবহার করে দমন সম্ভব হয়। তবে আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে ‘পাইমেট্রোজিন+নিতেনপাইরাম’ দ্রুতপের অনুমোদিত কীটনাশক যেমন: আম্ফান, পাইরাজিন, স্পেলেন্ডর ইত্যাদি ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।