আহসানুল হক জুয়েল, সংবাদদাতা : রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথিত অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের সমাবেশে যোগদানের শর্তে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা দেয়ার প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হয়ে কিশোরগঞ্জের নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলা থেকে যাওয়া ৮টি যাত্রীবাহী বাস আটকে দিয়েছে স্থানীয় ছাত্রজনতা। গতকাল সোমবার বাজিতপুর উপজেলাধীন হিলয়িা বাজারে বাসগুলো আটক করা হয়। অপরদিকে ঢাকায় সমাবেশস্থলে পৌঁছার পর আরও ৪টি বাস সেনা সদস্যরা আটক করেছে।
সমাবেশে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে ঢাকাগামী নিকলী ও বাজিতপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের একাধিক নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদেরকে পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ঢাকায় একটি সংস্থার মাধ্যমে ট্রেনিং শেষে সুদবিহীন সর্বনিম্ন এক লাখ টাকার প্রলোভন দেখায় একটি চক্র।
প্রয়োজনে শর্তানুযায়ী আরও বেশি টাকা দিবে বলে আশ্বাস দেয় তারা। তবে এর পেছনে কি উদ্দেশ্যে ছিল, এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ সমাবেশগামী এসব যাত্রী। তাদের অনেকের হাতে ছিল অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের আহ্বায়ক আ.ব.ম মোস্তাফা আমিনের ছবি সম্বলিত ছোট লিফলেট। ব্যানারে লেখা ছিল লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার করবো, বিনা সুদে পুঁজি দেবো।
নারীদের ভাষ্য, এলাকার স্থানীয় কিছু নারীর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে ঢাকা নিয়ে যাওয়ার জন্য জনপ্রতি অগ্রিম ৬০০ টাকা করে হাতিয়ে নেয় চক্রটি। নারীদের দাবি, অসৎ উদ্দেশ্যের কথা তাদের জানা ছিল না। এসবের জন্য কে বা কারা দায়ী এই কথা সমাবেশগামী নারীরা এখনো সঠিকভাবে জানেননি বলে উল্লেখ করেছেন।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর পেছনে সরকারকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসূত্র থাকতে পারে। তবে এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মীর সাথে মুঠোফোনে কথা হয়। তবে তারা এই পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলেও দাবি করেছেন।
নিকলী উপজেলার বদ্বীপ ছাতিরচর গ্রামে গেলে নৌমাঝি থেকে শুরু করে নৌঘাটের একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, সকালে কমপক্ষে ৭-৮শ’ নারীকে নদী পার হতে দেখা গেছে, যারা বাসে করে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। বাসগুলো নদীর ওপারে তাদের অপেক্ষায় ছিল। তবে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শামসুজ্জামান চৌধুরী ওরফে ইয়ার খাঁন বলেন, তিনি এলাকাতেই অবস্থান করছেন।
তবে সমাবেশের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তবে ফোনে খবর পেয়ে নৌ ঘাটে গিয়ে নারীদের পারাপারের দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন তিনি। এলাকায় গুঞ্জন উঠেছে, এর পেছনে উপর মহল থেকে শুরু করে তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকতে পারে। তবে মাঠ পর্যায়ে স্থানীয় নারীরা নেতৃত্ব দিয়েছে।
এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ছাতিরচরের দক্ষিণ হাটির রমজান আলীর পুত্রবধূ মোকাররমের স্ত্রী মৌসুমি ৭-৮শ’ নারীকে ঋণের কথা বলে এভাবে সমাবেশে যোগদানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে। মৌসুমির শ্বাশুরি জুহরা জানান, মৌসুমির বড় বোনের জামাতা কুলিয়ারচর উপজেলার বাজরা এলাকার মাসুকের ছেলে মাসুদ টাকার লোভ দেখিয়ে এলাকার অসংখ্য নারীকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছেন। একই কৌশলে হিলচিয়া ইউনিয়নের অসংখ্য নারীকেও ঢাকা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৫ নভেম্বরের সমাবেশে যোগদানের উদ্দেশে ২৪ নভেম্বর রোববার সন্ধ্যায় বাজিতপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক নারী পুরুষ নিয়ে ৪টি বাস ঢাকায় যায়। রাতে ঢাকা অবস্থানকালে ছাত্র-জনতার হাতে তারা আটক হন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছুটে এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন। তবে এ কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িতদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
নারীদেরকে জানানো হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রস্তাবনা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে ওই টাকা দেশে ফিরিয়ে এনে প্রত্যেক আবেদনকারীকে এক লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে।
এ ছাড়া দেশের ৬৪ জেলা থেকেই লোকজন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে যোগদান করবে বলে নারীদেরকে জানায় চক্রটি।
ছাতিরচরের নামা বাজারের দোকানি লায়েছ মিয়া জানান, সকালের দিকে তিনি দোকান থেকে দেখতে পান প্রায় ৭-৮শ’ যাত্রী ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশে নদী পার হয়েছে।
সাবেক ৬ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জহির আহমেদ বলেন, ট্রেনিং শেষে সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে ২ লাখ করে টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সবার কাছ থেকে ৬’শ টাকা করে নিয়েছে। তিনি ১০ জন নারীকে নিষেধ করে ফেরত পাঠিয়েছেন।
বাজিতপুর উপজেলার নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারাশিদ বিন এনাম ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আটক বাস এবং ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এই বিষয়ে নিকলী থানার ইউএনও পাপিয়া আক্তারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি।
নিকলী উপজেলার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কাজী আরিফের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি দাপ্তরিক কাজে কিশোরগঞ্জে রয়েছেন বলে জানান। বাজিতপুর উপজেলার ইউএনওর কাছে তিনি ঘটনা শুনেছেন, এমনকি ছাতিরচরে পুলিশ ও সেনা বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন বলেও তিনি জানান।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী, বিপিএম’র সঙ্গে এই ঘটনার বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।