মোহাম্মদ জাকির হোসেন, হোসেনপুর প্রতিনিধি :
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে নিয়ম না মেনে ভর দুপুরেই জমিতে কীটনাশক স্প্রে করছেন কৃষকরা। এতে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন কৃষকসহ ভোক্তাগণ। নির্দিষ্ট সময় ছাড়া যেনতেন সময়ে কীটনাশক স্প্রে করলে ফসলের উপকারী পোকাগুলো মারা যায়। মৃত পোকামাকড় খেয়ে পাখিও মারা যায়।
যে জন্য পরিমাণ মাত্রা বজায় রাখা ও নির্দিষ্ট সময় মেনে এ কীটনাশক স্প্রে করা উচিত। যা তদারকি করা ও পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব স্থানীয় কৃষি অফিসারদের। কিন্তু এ কাজটি এখন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। যে জন্য কৃষকদের উৎপাদিত ফসল ধান, গম, সবজিসহ অন্যান্য ফসলের রোগ-বালাই ও পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কৃষকরা জমিতে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক (বিষ) দিয়ে থাকেন।
তবে সঠিক পরামর্শের অভাবে নিরাপদ পদ্ধতিতে কীটনাশক ব্যবহার না করায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন এখানকার কৃষকরা। ওই কীটনাশক সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জানা গেছে, উপজেলার একশ্রেণীর কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিরা নানা রকম ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে কৃষকদের জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করছেন। যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহারের ফলে কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সহজেই আর মরছে না পোকামাকড়। পাশাপাশি কীটনাশক ব্যবহারে পরিবেশ বিষাক্ত ও মৃত্তিকার উর্বরাশক্তি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কৃষকরা ভরদুপুরে তাঁদের জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কারও নাকে-মুখে কোনো কাপড় বা মাস্ক নেই। অনেক কৃষককে দেখা গেছে টি-শার্ট পরে জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন। কেউবা ধানের জমিতে সারের সঙ্গে আগাছানাশক মিশিয়ে হাতমোজা ছাড়াই হাত দিয়ে ছিটাচ্ছেন। কীটনাশকের প্যাকেট বা বোতলের গায়ে স্পষ্ট অক্ষরে ‘বিষ’ লেখা থাকলেও তা কেউ আমলেই নিচ্ছেন না। নিয়মনীতি না মেনেই এলাকার কৃষকরা যে যার মতো জমিতে কীটনাশক ছিটাচ্ছেন।
স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৫৬ সালে মাত্র তিনটি কীটনাশক কোম্পানির মধ্যদিয়ে এ দেশে ফসলে বিষ প্রয়োগ ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে দেশে ২১১টি ট্রেডের ওষুধ বৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ ডিটিটি, হেপটাকোরিন ছাড়াও আরো নানা রকম গ্রæপের কীটনাশক বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
বর্তমানে কীটনাশক আমদানি ও বাজারজাতকরণে যথাযথ নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না বিধায় কীটনাশকের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কৃষকদের ধারণা। বিশেষজ্ঞরা জানান, ওই সব কীটনাশকের আয়ু ২০ বছর। ফলে এসব কীটনাশক যত্রতত্র ব্যবহার করা হলে মানুষের ব্রেন, হার্ট, কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এরই মধ্যে অনেক রকম পাখি ও মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
শাহেদল ইউনিয়নের কুড়িমারা গ্রামের সবজি চাষি পারভেজ জানান, শিমের পোকা দমনে প্রতিদিন ফ্যান ফ্যান, সিকিউর, বেল্টসহ নানা রকম কীটনাশক প্রয়োগ করেন। সাহেবের চর গ্রামের কুদ্দুস, চৌদারগ্রামের কাশেমসহ অনেকেই জানান, বেগুন, শিমে প্রতিদিন কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। মৌসুমে তারা সবজি ক্ষেতে ১৬ বার কীটনাশক স্প্রে করে।
কৃষকরা মনে করেন আগে ফসল পরে জীবন। উপজেলার জিনারী ইউনিয়নের চরকাটিহারী গ্রামের স্কুলশিক্ষক ও সবজি চাষি কাশেম জানান, সরকারের কীটনাশকের ওপর কর্তৃত্ব না থাকার কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশীয় পদ্ধতি বা আইবিএম (সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা) পদ্ধতির মাধ্যমে অধিক ফসল পাওয়া সম্ভব।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তানভীর হাসান জিকো জানান, কীটনাশক ছিটানোর সময় নিরাপদ পোশাক ব্যবহার না করলে নাক ও মুখ দিয়ে বিষ শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া হতে পারে। এতে মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে। তাই জমিতে কীটনাশক ছিটানোর ক্ষেত্রে নাক-মুখে মাস্ক ও হাতে মোজা ব্যবহার করা জরুরি। বিষয়টি নিয়ে কৃষকের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো দরকার’।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ একেএম শাহজাহান কবির জানান, কৃষকদের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছি। জমিতে কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়। তাই কীটনাশক ব্যবহার না করে অধিক ফসল ফলানোর জন্য জৈব পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে কীটনাশকের ব্যবহার বিধি ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়ে আসছেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।