প্রতিনিধি, পাকুন্দিয়া (কিশোরগঞ্জ) মুহিব্বুল্লাহ বচ্চন : সব শঙ্কা কাটিয়ে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় আমন ধান কাটার ধুম পড়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সর্বত্রই উৎসব মুখর পরিবেশে আমন ধান কেটে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কৃষকেরা। আমন রোপনের শুরু থেকেই একের পর এক দূর্যোগ দেখা দিলেও ভালো ফলন এবং দাম ভালো থাকায় ঘাম জড়ানো পরিশ্রম ভুলে গিয়ে এখন কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব।
সরেজমিনে উপজেলার চরফরাদী, জাঙ্গালিয়া, এগারসিন্দুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে সর্বত্রই আমন ধান কাটার ধুম পড়েছে একযোগে। কৃষকেরা যার যার সামর্থ অনুযায়ী দৈনিক হাজিরায় কাজের লোক নিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে ধান কাটছেন। কেউ কেউ আবার চুক্তিতে ধান কাটার কাজ করাচ্ছেন।কৃষকদের পাশা পাশি তাদের পরিবারের সদস্যরাও আমন ধান কাটার কাজে সহায়তা করছেন।
খড় ও ধান সংগ্রহের সুবিধার জন্য প্রথমে ধান গাছগুলো কেটে জমিতে বিছিয়ে রাখছেন রোদে শুকানোর জন্য। দুই তিন দিন ভালোভাবে শুকিয়ে আঁটি বেঁধে একটি স্থানে জমা করছেন। পরে জমিতে মোটা পলিথিন বিছিয়ে পুরাতন ড্রাম বা গাছের গুড়ি বিছিয়ে ধান থেকে খড় আলাদা করছেন।
কেউ কেউ আবার মেশিনের সাহায্য ধান মারাইয়ের কাজ করছেন। পরে ধানগুলো রোদে শুকিয়ে ঘরে তুলছে। সেখান থেকে ঘরের লোকজনের খাবারের চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ধান রেখে বাকিটুকু বাজারে বিক্রি করছেন। আবার কোনো কোনো কৃষক বেশি দামে বিক্রির আশায় সব ধানই সংগ্রহ করে রাখছেন।
বাংলা অগ্রাহায়ণ মাসের প্রথম দিন থেকেই এখানকার কৃষকেরা আমন ধান কাটা শুরু করেন। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত, তাই তারা এ ফসলটাকে উৎসব মুখর পরিবেশে কেটে ঘরে তুলেন। এ সময় গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরেই শুরু হয় নবান্ন উৎসব।
নতুন ধান দিয়ে কৃষকের পরিবারের সদস্যরা নানা রকমের পিঠা-সেমাই বানিয়ে এই উৎসবটি পালন করে থাকেন। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ির জামাইকে দাওয়াত করা এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর একটি রীতি যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে এখানকার মানুষ।
সরকারীভাবেও উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উদ্যোগে অগ্রাহায়ণ মাসের ১ম দিন নানা আয়োজনে নবান্ন উৎসব উদযাপন করে থাকে। এবছর গত শনিবার উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের খামা নতুন বাজার এলাকায় নবান্ন উৎসব উদযাপন করা হয়।
এতে গ্রামীণ হারানো ঐতিহ্য ‘কপালে গামছা বেধেঁ এবং মাথায় বাশের তৈরি টুপি পরে’ ধান কাটার মধ্য দিয়ে নবান্ন উৎসব শুরু করে। এতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও মো. বিল্লাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে উৎসবের উদ্বোধন করেন। এসময় ইউএন নিজেও কৃষকদের সাথে ধান কাটেন।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এই উপজেলায় এ বছর ১০ হাজার দুইশত হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এখানকার কৃষকরা বি-৪৯, বি-৮৭, বি-৭৫ ও হাইব্রিড জাতের ধানের চাষাবাদ করে থাকেন। অধিক ফলনের আশায় আবাদকৃত জমির ৪০ শতাংশই হাইব্রিড ধানের চাষ করা হয়েছে।
জানা যায়, এ বছর আমন ধান আবাদে বীজতলা থেকে শুরু করে চাষাবাদ, সার-কীটনাশক প্রয়োগ এবং ধান মারাই পর্যন্ত প্রতি বিঘা জমিতে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ২০ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। প্রতি মণ ধানের বর্তমান বাজার মূল্য ১২০০ টাকা থেকে ১৩০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের তারাকান্দি গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর তিনি সাড়ে তিন বিঘা জমিতে বি-৪৯ জাতের ধান চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি তাঁর খরচ হয়েছে ৮ হাজার টাকা। ফলন ভালো হওয়ায় সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ৬০ মণ ধান পাওয়ার আশা প্রকাশ করছেন। এ বছর ধানের দাম ভালো থাকায় তিনি খুব খুশী মনে ধান সংগ্রহ করছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-ই-আলম জানান, এ বছর আমন রোপনের পর থেকেই অতি বৃষ্টির কবলে পড়ে আমনের ক্ষেতগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে ইঁদুরের আক্রমণ, কারেন্ট পোঁকা ও ছত্রাকের আক্রমণে কৃষকদের মাঝে এক প্রকার হতাশা তৈরী হয়। কৃষি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ দিন রাত শ্রম দিয়ে কৃষকদের মাঝে শক্তি সাহস যুগিয়েছে। পোঁকার আক্রমণ থেকে ফসলকে বাঁচাতে আলোক ফাদ এবং ইঁদুর দমন করতে সময়মত কীটনাশক প্রয়োগ করায় এবারও আমন ধানের ভালো ফলন হয়েছে। আর এজন্য তিনি সকল উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগনকে ধন্যবাদ জানান।