এফএনএস (হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) : দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র জোয়ার ভাটার নদী, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হ্যারিটেজ চট্টগ্রামের হালদা নদী। প্রতি বছর এ নদীতে একটি বিশেষ মূহুর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতল, মৃগেল ও কালিবাউস তথা কার্প জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। যে সময়টাকে তিথি ও স্থানীয় ভাষায় জো বলা হয়ে থাকে। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে পরিবেশ অনূকুলে থাকলে অর্থ্যাৎ বজ্রসহ বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢলের প্রকোপ থাকলে নদীতে মাছ ডিম ছাড়ে। আর তা শুধু স্থানীয়ভাবে হলে চলবেনা তা নদীর উজানেও হতে হবে। ফলে নদীতে পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি হয়। এর দ্বারা পানি অত্যন্ত ঘোলা ও খরস্লোতা সৃষ্টি হলে মা মাছ ডিম ছাড়ে।
চৈত্র বৈশাখ মাস থেকে হালদা সংযোগ খাল ও ছরা থেকে কার্প জাতীয় মা মাছ হালদায় প্রবেশ করে। মা মাছ ডিম ছাড়ার ফলে তা হালদার দু পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা তা সংগ্রহ করে হ্যাচারীর পাকা কুয়া, ব্যক্তিগত মাটির কুয়ায় সংরক্ষণ করে তা থেকে রেণু উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাছ চাষিদের উচ্চমূল্যে বিক্রি করেন। এ মাছের আলাদা বৈশিষ্ট যেমন স্বাদে অতুলনীয় এবং ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাশাপাশি অন্যান্য মাছের চাইতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও সহনশীলতা বেশি বলে জানা গেছে।
রুইজাতীয় মাছের প্রকৃত বংশধরদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য হালদা নদীর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিকল্প নাই। হালদা নদীকে চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ বলা হয়। কারণ চট্টগ্রাম শহরে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে। তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য চট্টগ্রাম ওয়াসা দিনরাত যে পানি সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি এই হালদা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। চট্টগ্রাম শহরের একদিকে বঙ্গোপসাগর, একদিকে পাহাড় অন্যদিকে কর্ণফূলী নদী।
তার মধ্যে একমাত্র ফ্রেশ ওয়াটার সোর্স হচ্ছে হালদা নদী। কোনো কারণে যদি হালদা নদী বিপন্ন হয়, তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রাই বিপন্ন হবে। আর সে হালদা নদীই তার নাব্যতা হারাচ্ছে বালু ভরাটের কারণে। হালদা নিয়ে সরকারি বেসরকারিভাবে প্রতিনিয়ত মাতামাতি থাকলেও খননে কোন উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেউ। অনেকের মতে এর পেছনে অদৃশ্য কোন কারণ রয়েছে। অথচ হালদা পাড়ের বাসিন্দা, প্রকৃত ডিম সংগ্রহকারী, জনপ্রতিনিধি সবার একই মতামত হালদা খননে ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে হালদার প্রাকৃতিক পরিবেশ। বঞ্চিত হবে জাতীয় নদী ঘোষণা থেকে।
সরেজমিনে হালদা পাড়ের বাসিন্দা, ডিম সংগ্রহকারী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নদীর অনেক স্থানে হাঁটু পানি কোথাও কোমর পানি। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা হারানোর সত্যতা ফুটে উঠে। আগে ডিম সংগ্রহের মৌসুমে যেখানে নব্বই থেকে একশ বিশ ফুট গভীরে নৌকার নোঙ্গর ফেলা হত সেখানে থেমেছে ত্রিশ ফুটে। স্বাভাবিক জোয়ারের পানি কখনো এলাকায় প্রবেশ করেনি এখন জোয়ার সাথে বৈরী আবহাওয়া হলেই এলাকার রাস্তাঘাট বাড়ির উঠোন তলিয়ে যায় পানিতে। হালদার পানি প্রবেশ করায় হালদার পাড়ে ক্ষেত খামার প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বিশেষ করে খ্যাত মিস্টি মরিচের চাষ।
হালদা পাড়ের বাসিন্দা ও ডিম সংগ্রহকারী মোঃ লোকমান (৬৯), মোঃ জাফর (৭০), আবু তৈয়্যব (৫৫) মোঃ শফি (৪৬) বলেন, যারা হালদার প্রতিনিয়ত খবর রাখেন তাদের কাছে এ বিষয়টি অবগত না হওয়ার কোন কারণ নাই। যদি হালদা খননে ব্যবস্থা নেয়া না হয় বর্তমানে হাতে গোনা মা মাছের ডিম ছাড়ার যে কয়টি কুম রয়েছে তাও ভরাট হয়ে বিলীন হয়ে যাবে। আর কুম বিলীন হলে কার্প জাতীয় মা মাছ কখনো ডিম ছাড়বেনা। প্রাকৃতিকভাবেই একসময় হালদায় আগমন তাদের বন্ধ হয়ে যাবে। যার জন্য হালদা আজ দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের কাছে পরিচিত তা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে হালদা নিয়ে এত স্বপ্ন দেখা বৃথা।
হালদা পাড়ের বাসিন্দা ও গড়দুয়ারা ইউপি চেয়ারম্যান সরোয়ার মোর্শেদ তালুকদার বলেন, যেহেতু হালদার উৎপত্তিস্থল পাহাড় সেহেতু প্রতিনিয়ত পাহাড়ের বালুকণা হালদায় এসে পড়ছে। অন্যদিকে হালদা নদীর সাথে অনেক গুলো শাখা খালের সংযোগ রয়েছে। শাখা খালের বালু, আবর্জনা এবং বৈর্জ্য এসে পড়ছে হালদায়। ড্রেজার দিয়ে খননে হালদা ও তার পাড় ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা সত্য কিন্তু প্রশাসন পরিকল্পনা করে যদি ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে বালু উত্তোলনে ব্যবস্থা করে তাহলে ক্ষতি কোথায়।
এতে যেমন হালদা গভীরতা ফিরে পাবে তেমনি কিছু বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। একইসাথে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করলে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা পড়বে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, যেহেতু বৃষ্টি হলেই হালদা নদীতে পাহাড়ি উজানের ঘোলা পানি অর্থ্যাৎ পাহাড়ি বালু কণা নেমে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয় এবং এ নদী লম্বা ও সরু হওয়ায় পাহাড় থেকে নেমে আসা বালি কণা মিশ্রিত পানিতে হালদা ধীরে ধীরে ভরাট হয় এবং হচ্ছে সেহেতু ম্যানুয়ালি তথা ডুবুরি দিয়ে যদি বালু উত্তোলন করা হয় হালদা নদীর তেমন ক্ষতি হবে বলে মনে করেন না। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় চর লক্ষ্য করা গেছে সেখানেও যদি এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করা হয় তাহলে হালদার ক্ষতি নয় বরং উপকার হবে। তবে এসবের অনুমতি জেলা প্রশাসক মহোদয়ের হাতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ২০০৭/৮ সালের দিকে কর্ণফুলি নদীতেও এমন বার্তা ছিল বালু উত্তোলন করলে ক্ষতি হবে কিন্তু পরে যখন দেখতে পেল ভরাট হয়ে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে তখন কর্তৃপক্ষ বালু মহালই ঘোষণা করে। যা এখনো পর্যন্ত জারি আছে।একসময় হালদার অবস্থাও সেই রকম হবে। সময় থাকতে হালদা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলন অনেক জায়গায় চলছে তবে তা প্রশাসনের আওতামুক্ত। যদি পরিকল্পনা করে সরকারি ভাবে করা হয় তাহলে হালদা তার গভীরতা ফিরে পাবে। স¤প্রতি মৎস্য অধিদপ্তরের আয়োজনে রাউজান উপজেলায় একটি হালদা বিষয়ক কর্মশালায় এ বিষয়সহ অনেকগুলি বিষয় তুলে ধরেছেন হালদার সাথে জড়িত অনেকে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, যদি মাটিতে কম্পন না হয়, পাড় না ভাঙ্গে একইসাথে পরিবেশের যদি বিপর্যয় না ঘটে তাহলে ম্যানুয়ালি পদ্ধিতে বালু উত্তোলন করা যায়। হালদার নাব্যতা রক্ষার্তে এনিয়ে অনেকেই এখন চিন্তাভাবনা করছেন। তবে পরিবেশ সমীক্ষা করে ওই দিকে এগোতে হবে। এর জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত লাগবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, জোয়ার ভাটার নদীর অন্যতম সমস্যা হচ্ছে বালি/পলি জমা। পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে যায়, পানি প্রবাহ পরিবর্তন, বিভিন্ন জলজ প্রাণীর বাসস্থান ধ্বংস, কুম ভরাট, জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পলিদূষণ, পানির গুনাবলি নষ্ট, ও পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেনের পরিমান কমে যায়। জোয়ার ভাটার নদী হালদা ও এর শাখা খালের বিভিন্ন স্থানে বালি জমে নদীর গভীরতা কমে গেছে, কুম ভরাট, কার্পজাতীয় মাছের প্রজননস্থান পরিবর্তন, ও পানি প্রবাহ কমেছে তাই হালদা নদীকে কার্পজাতীয় মাছ, গাঙ্গেয় ডলফিন এবং জলজ প্রাণীর নিরাপদ বাস্তুতন্ত্রে পরিনত করার লক্ষ্যে হালদায় নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য বালি জমাট স্থান থেকে ম্যানুয়্যালি প্রয়োজন মতো বালি অপসারণ করতে হবে।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলনকে সমর্থন করে বলেন, এ পদ্ধতিতে বালু উত্তোলনে যেমন হালদার গভীরতা ফিরে আসবে তেমন বালুর চাহিদা পুরণ হবে। পাশাপাশি যদি হালদার শাখা খালগুলোর প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দেয়া হয় তাহলে শাখা খালের স্বাভাবিক ¯্রােতে হালদায় পাহাড়ের জমানো পলি মাটি এমনিতে সরে যাবে। তিনি বলেন, ম্যানুয়ালি বালু উত্তোলনের নির্দেশনা অনেক আগে থেকেই দেয়া আছে কিন্তু বাস্তবায়ন নাই। নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে হালদার নাব্যতা রক্ষা পাবে।