মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন

ভাসমান স্কুল শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৪
  • ৪২ Time View

স্টাফ রিপোর্টার (কিশোরগঞ্জ) মোঃ শরফ উদ্দিন জীবন : বর্ষায় ”নাও” আর শুকনায় ”পাও”। কিশোরগঞ্জের হাওরের মানুষের এটি প্রবাদ বাক্য ও চিরচেনা রূপ। এখানকার জনপদের মানুষ সবসময় অবহেলিত। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছে পড়া এক বিরাট জনগোষ্ঠী’র বসবাস নিকলী উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদীপাড়ের দুটি ইউনিয়ন ছাতিরচর ও সিংপুরের মানুষের। এ দুই ইউনিয়নের অধিকাংশের পেশা কৃষি ও মৎস্যজীবী।

চরম দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করা এই মানুষগুলোকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা “পপি” চালু করেছে ভাসমান স্কুল। অভিভাবক ও এলাকাবাসীর কাছে এসব স্কুল এখন জলে ভাসা স্কুল হিসাবেই পরিচিতি লাভ করেছে।

২০০৯ সালের দিকে সংস্থাটি ছাতিরচর ইউনিয়নে চারটি এবং সিংপুর ইউনিয়নে তিনটি একতলা ও দ্বিতল নৌকায় ভাসমান স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। একই সঙ্গে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণসহ নানা সেবা প্রদানের দায়িত্ব নেয়। বিনামূল্যে বই-খাতা, কলম, জ্যামিতি বক্স, স্কুল ড্রেস, ব্যাগ, জুতা, টিফিন ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে হাওড়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে সাতটি ভাসমান স্কুল।

এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের মনোরঞ্জনে রয়েছে খেলাধুলার আয়োজন। সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত চলে এসব ভাসমান স্কুলের ক্লাস। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে রয়েছে লাইব্রেরি ও শিক্ষণীয় ফটো গ্যালারির পাশাপাশি খেলাধুলার নানাবিধ আয়োজন। আর্থিক সংকটের কারণে একসময় অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত ছিল।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মীম আক্তার জুঁই বলেন, আমাদের গ্রামের চারপাশে নদী। এখানে একটি স্কুল থাকলেও আমাদের লেখাপড়া করার মতো যে খরচ প্রয়োজন তা সম্ভব হয় না। ভাসমান স্কুলে প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়ালেখা করে আসছি। স্কুলে যা প্রয়োজন সবই স্যারেরা আমাদের দিয়ে দেন। স্কুল ড্রেস থেকে শুরু করে টিফিন পর্যন্ত সব।

মা-বাবা হারানো শিক্ষার্থী আকাশের ভাষ্য, আমার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর পড়াশোনা করতে পারছিলাম না। এমন সময় স্কুলের একজন ম্যাডাম আমাকে খেলার মাঠে গিয়ে পড়াশোনার কথা বললেন। আমিও পড়াশোনা করতে আগ্রহ দেখিয়েছি। এরপর আমাকে পপি’র ভাসমান স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে সব স্যারেরা দিয়েছেন। কোন কিছু আমার কিনতে হয়নি। এখন আমি চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এসময় ম্যাডাম আমাকে ডাক না দিলে পড়ালেখা করতে পারতাম না।

শিক্ষার্থী নাবিলা আক্তার বলেন, আমাদের এখানে বন্যা হয়। বন্যার সময় অনেক স্কুল ডুবে গেলেও আমাদের স্কুল ভেসে থাকে। কখনও ক্লাস বন্ধ থাকে না। একদিন স্কুলে না আসলে স্যার অথবা ম্যাডাম আমাদের বাড়িতে যায়। খোঁজ খবর নেন আমরা কেন স্কুলে আসিনি। সমস্যা থাকলে সমাধানের চেষ্টা করেন।

ভাসমান স্কুলের শিক্ষিকা রতœা আক্তার বলেন, প্রাক প্রাথমিক ক্লাস থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করি। এখনও ৩০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। এখান থেকে বই, খাতা, কলম, পেন্সিল, ড্রেস, স্বাস্থ্য সেবাসহ যাবতীয় সকল কিছু ফ্রিতে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় দুর্যোগের সময় সকল শিক্ষার্থী’র পরিবারকে ত্রাণ দেওয়া হয়।

অভিভাবক শহীদ মিয়া বলেন, আমরা অনেক গরীব মানুষ, পপি’র ভাসমান স্কুল হওয়াতে ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা করাতে পারছি। আমার বড় ছেলে এখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছে। ছোট ছেলেকেও ভর্তি করেছি। সকল কিছু স্কুল থেকেই দেওয়া হয়। আমাদের দাবি আরও স্কুল হোক। কেউ অশিক্ষিত না থাকুক। আমাদেরকে করোনার সময় ও বন্যার সময় সহায়তা দিয়েছে।

অভিভাবক দুধমেহের আক্তার বলেন, আমরার সময় এমন স্কুল ছিল না। গরীব মানুষ তাই লেখাপড়া করতে পারছি না। আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। কোন টাকা লাগে না। সব পপি’র থেকে দেওয়া হয়। আমার দুই সন্তান এই স্কুলে পড়ালেখা করে।
নিকলী ভাসমান স্কুলের প্রকল্প সমন্বয়কারী জহিরুল ইসলাম বলেন, নিকলী উপজেলার ছাতিরচর ও সিংপুর ইউনিয়নে ২০০৯ সাল থেকে ভাসমান স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছি। ইতোমধ্যে এক হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে অধ্যয়রত আছে।

এছাড়াও যৌতুক, বাল্যবিবাহসহ তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। এই হাওরঞ্চলে ভাসমান স্কুল সাড়া ফেলেছে। অধিক চাহিদাও বেড়েছে। কারণ যেহেতু সারাবছর পানি থাকে। আমাদের স্কুল গুলো গ্রামের কাছাকাছি থাকায় তারা সহজে স্কুলে আসতে পারে। বর্তমানে সাতটি ভাসমান স্কুল চালু আছে। যেখানে ৩৩০জন শিক্ষার্থী রয়েছে।

পপি’র নির্বাহী পরিচালক মুর্শেদ আলম সরকার বলেন, এখানকার মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। সরকারি স্কুল থাকলেও যথেষ্ট না। তাই ভাসমান স্কুলের প্রতি চাহিদা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের স্কুলকে এমনভাবে তৈরী করেছি যে প্রতিটি স্কুলে একসাথে ৫০ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করতে পারবে।

দু’তলা বিশিষ্ট লঞ্চে একসাথে ১০০ জন শিক্ষার্থী পড়তে পারবে। ১ম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে। এখান থেকে প্রাইমারি পাস করার পর আমাদের পক্ষ থেকে হাই স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করি। প্রতিদিন টিফিন দেওয়া হয়।

তাদের পুষ্টির কথা চিন্তা করে রুটিন অনুযায়ী একেকদিন একেক ধরনের খাবার দেওয়া হয়। এমনভাবে পাঠদান করা হয় যে সরকারি স্কুলের চাইতেও অনেক ভালো রেজাল্ট হয়ে থাকে। যার কারণে আরও চাহিদা বাড়ছে। আমরা চাই এখান থেকে যারা বের হয়ে যাবে তারা যেন একদিন এই স্কুল গুলোর দায়িত্ব নেয়।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি’রি এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে যে মিশন নেওয়া হয়েছে তা একটি ভালো রোল প্লে করছে। আমরা দেখেছি বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের যে আলোকিত লাইব্রেরী রয়েছে তা শহরের মানুষের কাছে বই পৌঁছিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই সেবাটা দেওয়ার আর কোন মাধ্যম নাই। যেটা হচ্ছে তা আমাদের দেশের অন্যান্য জায়গায় ভালো অনুকরনীয় হতে পারে। এই স্কুল থেকে শুধু শিক্ষা না স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক ভূমিকা রাখছে।

সরকারের পক্ষ থেকে আমরা চিন্তা করতে পারি এই স্কুলগুলো থেকে সাপোর্টস আরো কোন কিছু করা যায় কিনা। এখানে হয়তো প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, কিন্তু যদি রেফার্ড করা হয় তখন দ্রুত পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ডেডিকেটেড কিছু স্পীড বোর্ড ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

আপডেট সংবাদ পেতে শতাব্দীর কন্ঠ পড়ুন, শেয়ার করে সাথে থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
All rights reserved © Shatabdir Kantha . Developed by SDTT Academy & Tech Liberty