এফএনএস : জাতীয় সংসদের অধিবেশনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, শিক্ষার দুর্নীতি ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয় বলেও জানান তারা। গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির বিরুদ্ধে ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় এসব অভিযোগ উঠে আসে।
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সংসদ সদস্যদের অন্যান্য অভিযোগের জবাব দিলেও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কিছু বলেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছয়জন সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাব দেন। এদের মধ্যে ৫ জন বক্তব্য রাখেন। ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসনের হামিদুল হক খন্দকার বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ সবসময় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য লেগেই আছে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাক্রম ও আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে ৫৭ বছর ধরে থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকে। নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। বরিশাল-৪ আসনের পংকজ নাথ বলেন, এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রশংসনীয়। তবে, কুড়িগ্রামের চিলমারীর কেউ যদি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিয়োগ পায় তাহলে সে যোগদান করে না।
পার্বত্য এলাকায় তো আরো সমস্যা। এ কারণে শিক্ষক নিয়োগের পরেও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই নিয়োগ অঞ্চলভিত্তিক করার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা অফিসারদের শূন্য পদগুলোতে দ্রæত নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, হাই কোর্ট এমপিদের সভাপতি হতে বারণ করলেন। বার বার এমপিরা এটা নিয়ে কথা বলেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন আপিল করবেন। আসলে এমপিদের সবাই অপমান করে।
সকলে এমপিদের অসম্মান করতে খুব উৎসাহ বোধ করেন। জানিনা হাই কোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদৌ আপিল করেছেন কি না। আজকে তিনি মন্ত্রী কালকে কোনো কারণে মন্ত্রী না হন, তাহলে তার অবস্থাও আমার মত হবে।” জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভবন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মানের পরিবর্তন হয়নি। আমার নির্বাচনি এলাকায় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ৪৩টি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে।
পাঠদান হয়নি ৫টিতে। ৫টি রুম ব্যবহার হয়। না হয় আরো ৫টিসহ ১০টি হল বা ২০টি হল। কিন্তু রুম ৪৩টি? এ যে অপব্যয়। আমার পাকা বাড়ি, পাকা পায়খানা কিন্তু খাবার নেই। এটা হচ্ছে আজকের শিক্ষার অবস্থা।” এমপিওভুক্তি নিয়ে অচলাবস্থার প্রসঙ্গও তোলেন তিনি। হাফিজ উদ্দিন বলেন, “এমপিওভুক্ত হয় না। আবেদন গ্রহণও বন্ধ। গত এক বছর আগে যাদের এমপিওভুক্তির চিঠি দেয়া হয়েছে, তাদের পিয়ন-চাপরাশি ১২ জনের বেতন হয়েছে, অন্যান্যের বেতন হয় না। হয়ত টাকা নেই। এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন টেবিলে যেতে হয়। ধাপে ধাপে টেবিল, মানে ধাপে ধাপে দুর্নীতি। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ২০-২৫ বছর পরে বেতন হচ্ছে। গ্রামের স্কুল মাদ্রাসায় ৪ তলা ভবন করা হয়েছে।
যারা এই পরিকল্পনা করেছে তারা তারা গ্রাম দেখেননি।” নাটোর-১ আসনের আবুল কালাম বলেন, “রেলের খালাসি পদে ২১০০ জন ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়েছে, যাদের সবাই মাস্টার্স পাস। এটা খুবই কষ্টের বিষয়। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু আগামী অর্থবছরে কমপক্ষে ৫ লাখ অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলে মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোনো শিক্ষিত বেকার না থাকে।” শিক্ষা খাতে দুর্নীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “শিক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি, এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কোনো শিক্ষক অবসর ভাতা পাচ্ছেন না।
আমার শ্যালক শিক্ষক ছিলেন, মারা গেছেন। আমি নিজে তিন বছর তদবির করার পরও অবসর ভাতা পাননি। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। এই দুর্নীতির কারণে গোটা জাঁতি গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবকরা আত্মহত্যা করছে।” ঝিনাইদহ-২ আসনের নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা গবেষণায় ব্যয় বাড়ানো প্রস্তাব করেন। সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, “দূরবর্তী জায়গায় অনেকে যোগদান করে না, এটা ঠিক। তারপরও বিগত ৬ মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।
এটি একটি সমস্যা, আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। এই যে একটা বাধা আছে আমরা আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা করছি।” এমপিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যেসব কলেজ হয়েছে সেখানে এমপিদের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এসেছিল। যার কারণে সংসদ সদস্যদের সভাপতি করা হচ্ছে না। আমরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিলল করার জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছি। অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে কথা বলেছি।
আইনমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে এটা আদালত থেকে নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা এ বিষয়ে লিভ আবেদন করেছি।” মন্ত্রী বলেন, “এবারের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষার তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও আরো ১৯টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। সেগুলোর অর্থ এই হিসাবে কিন্তু আসেনি। আমরা মনে করি শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ, সেটা যথাযথ।”
আইন মন্ত্রণালয়
আইন মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ পংকজ নাথ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান অধিকার রক্ষায় কমিশন গঠনের দাবি জানান। বিরোধী দলের সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, “আইন বড় লোকের জন্য। বিচারকের অভাব রয়েছে। বিচারের জন্য এই দরজা ওই দরজা ঘুরত ঘুরতে মানুষের জীবন শেষ।” তিনি প্রত্যেক বিভাগে হাই কোর্টের বেঞ্চ করার দাবি জানান। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সুন্দর সুন্দর ভবন হয়েছে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষ আদালতে ঘুরছে। মামলা জট বাড়ছে।”
সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র এমপি পংকজ নাথ বলেন, “জোবরা গ্রাম কী আগের মত আছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিয়ে যেখান থেকে শুরু হয়েছিল ড. ইউনূস সাহেবের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প বা গ্রামীণ ব্যাংক। “ক্ষুদ্র ঋণের নামে গরীব মানুষের.. কাগজে-কলমে বলছেন সাড়ে ১২ শতাংশ। ১০ হাজার টাকায় প্রতি সপ্তাহে আড়াইশ টাকা। প্রথম কিস্তিও আড়াইশ টাকা, শেষ কিস্তিও আড়াইশ টাকা। চারবার মাল্টিপ্লাই করেন তাহলে দেখবেন কত শতাংশ সুদ আসে। ইউনুস সাহেবের
পারিবারিক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিল ৩৫ শতাংশ, যেটা ৫ শতাংশের কম সুদে। আমাদের কথা হচ্ছে জোবরা গ্রাম কী আগের মত আছে নাকি বদলে গেছে?” তিনি বলেন, “বিএনপি-জামায়াত-প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ব্যাঙের ছাতার মত যে এনজিওগুলো আছে সেগুলো তদন্ত করে বন্ধ করা হোক।
মুজাহিদ (যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা) যখন মন্ত্রী ছিল, তখন তাদের ব্যাঙের ছাতার মত এনজিও লাইসেন্স দিয়েছিল। দয়া করে সেগুলো খুঁজে বন্ধ করুন।” এনজিওগুলো গরীব মানুষের সন্তানদের জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় করেছে কিনা সেই প্রশ্নও তোলেন পংকজ নাথ। “গরীব মানুষের রক্তচোষা পয়সা যেন কারও কারও ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোষাগারে জমা না হয়। মানুষ যাতে লভ্যাংশের সুবিধা পায়।
মাইক্রো ক্রেডিটের নামে গরীবের রক্তচোষা বন্ধ করুন।” সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান নয়। এটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতিষ্ঠান। এটি এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়। যেভাবে বিশ্বে পরিচয় দেওয়া হয়, তা সঠিক নয়। এটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান।
এটি শুধুমাত্র ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত। যদিও এরপরে নানা রকম ব্যবসা প্রসারিত করেছে তারা চার্টারের বাইরে গিয়ে।” সমাজকল্যাণে নিবন্ধিত কোনো এনজিও বেআইনি কাজ করলে, তার বিরুদ্ধে তথ্য দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান মন্ত্রী।