মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

সরকারি বোর ধান-চাল ও গম সংগ্রহ অভিযান : কৃষি কার্ড-ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-আর্দ্রতা আইনের ফাঁদে কৃষক : লাভ খাচ্ছে দালালরা

বিজয় কর রতন, প্রতিনিধি, মিঠামইন (কিশোরগঞ্জ)
  • Update Time : মঙ্গলবার, ২১ মে, ২০২৪
  • ১৪০ Time View

বিজয় কর রতন, প্রতিনিধি, মিঠামইন : প্রতি বছরের ন্যয় এবছরও সাধারণ কৃষকের কাছ থেকে বোরো মৌসুমের ধান-চাল ও গম সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এই অভিযান, নিয়ম-নীতির ফাঁক গলে দালাল আর প্রভাবশালীদের দৌরাত্বে তা ব্যহত হচ্ছে। কৃষকের লাভ যাচ্ছে ফড়িয়াদের ঘরে।

এবার সরকারিভাবে প্রতি মণ বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ২৮০ টাকা (প্রতি কেজি ৩২ টাকা)। কিন্তু প্রকৃত কৃষকেরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
দালাল আর প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। আর এতে সহায়তা করছে এক শ্রেণির খাদ্য কর্মকর্তা।

তবে খাদ্য কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কৃষকেরা সঠিক মানের ধান নিয়ে আসলে তাদের ধান কেনা হয়। কৃষক বাদে অন্য কারো থেকে ধান কেনার কোনো আইন বা সুযোগ নেই।

গত ৮ মে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এবার সরকার ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে। এর মধ্যে ধান কেনা হবে পাঁচ লাখ টন। সেদ্ধ চাল ১১ লাখ টন এবং আতপ চাল এক লাখ টন। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কেনা হবে। প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ধান ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকা। একই সঙ্গে ৩৪ টাকা দরে ৫০ হাজার টন গম কেনারও সিদ্ধন্ত নেয়া হয়েছে।

সাধারণ কৃষদের জন্য বোরো ধানই মুখ্য। কারণ চাল বিক্রি করেন চাতাল মালিকেরা। এবার গত বছরের চেয়ে ধানের দাম প্রতি কেজিতে দুই টাকা বেশি ধরা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার কৃষক রিপন মিয়া বলেন, আমাদের প্রতি মণ ধান উৎপাদনে এবার খরচ হয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি, সারের দাম বেশি, সেচের খরচ বেড়ে গেছে বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে।

আবার বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিক মতো সেচ দিতে না পারায় ধান চিট হয়ে যায়। রিপন মিয়া আরও বলেন, সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারলে লাভ থাকত। কিন্তু আমরা তো সেখানে যেতেই পারি না। দালালরা ওই কেন্দ্র পর্যন্ত আমাদের যেতেই দেয়না। তাই বাধ্য হয়ে ৮৫০-৯০০ টাকা মণ বিক্রি করছি। কিন্তু এই দামে ধান কিনে তারা সরকারের কাছে বেচে ১ হাজার ২৮০ টাকায়।

তিনি অভিযোগ করেন, নানা অজুহাতে আমাদের আটকে দেয়া হয়। এরমধ্যে আছে কৃষক কার্ড, ময়েশ্চার (আর্দ্রতা), ধানে চিটা। কেউ কেউ কেন্দ্রে যেতে পারলেও এইসব অজুহাতে ধান ফেরত দেয়া হয়। আমাদের পরিবহন খরচ গচ্চা যায়।

কিশোরগঞ্জের অষ্ট্রগ্রাম উপজেলার কৃষক মোঃ নাসির উদ্দিন এবার দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো পেয়েছেন। তিনি বলেন, প্রথমে কৃষককে কৃষি কার্ড পেতে হয়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। এরপর ধান নিয়ে গেলে লটারি করা হয়। লটারিতে যাদের নাম আসে তাদের ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা হয়। যদি আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হয় তাহলে ধান নেয় না।

তিনি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, গত বছর আমার যে ধান সঠিক আর্দ্রতা নেই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেই ধান দালালের কাছে বিক্রি করার পর তাদের কাছ থেকে একই ধান ক্রয় কেন্দ্র নিয়েছিল। দালাল ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের একটা অবৈধ যোগাযোগ আছে। তারা মিলে একটা ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট গড়ে তোলেছে। এর সঙ্গে গুদামের শ্রমিকেরাও জড়িত। ঐ সব শ্রমিকদের আবার সরকার কৃষি কার্ড আছে।

সরকারি পর্যায়ে ধান কেনার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েই সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের বঞ্চিত করেন। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। এবার প্রতি মণে তারা কমপক্ষে ৩০০-৩৫০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। এই লাভের ভাগ প্রশসন এবং জনপ্রতিনিধিরাও পান বলে অভিযোগ আছে।

নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষকের- কৃষি কার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার পাশাপাশি ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের মধ্যে থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কৃষকের কাছে তো আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নেই, ফলে সে ধান কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে বিপাকে পড়ে। কারণ তাকে বাড়ি গিয়ে ধান আরো শুকিয়ে আনতে হলে দ্বিগুণ পরিবহন খরচ গুণতে হয়। আর কৃষি কার্ড পেতে পোহাতে হয় নান জটিলতা। কারণ জমির মালিকানা না থাকলে কার্ড পাওয়া যায় না। বর্গা চাষীরা তাই কৃষি কার্ড পান না। আর ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই অনেকের। যদিও ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ আছে।

এবার হাওড় এলাকায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠাইমন উপজেলার কৃষক আরমান হোসেন এবার পাঁচ একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। তার ভাই করেছেন ৩৫ একর জমিতে। তিনি বলেন, ভালো ফলন হলেও আমরা সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারছিনা। বাইরে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানো দালাল আর ক্ষমতাসিন দলের নেতা-কর্মীদের দাপট। তাদের কাছেই আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে।

আরমান হোসেন আরও বলেন- আমরা ৯০০-৯৫০ টাকা মণ তাদের কাছে বিক্রি করছি। এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনার কথা থাকলেও কারোর দেখা নাই। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে দালাল আর ফড়িয়ারা। আমরা তাদের ধান দিয়ে দিচ্ছি। অভিযোগ আছে, সামর্থবানরা সরকারিকেন্দ্রে বিক্রি করতে না পেরে ধান ধরে রাখছেন। বাজার চাঙা হলে তখন বিক্রি করবেন।

মিঠাইমন উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ এনামুল হক অবশ্য দালাল ও ক্ষমতাসিন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌরাত্ম্য অস্বীকার করে বলেন- কৃষক ছাড়া অন্য কারো এখানে ধান বিক্রির সুযোগ নেই। আমরা কৃষক কার্ড দিয়েছি। সেই কার্ড দেখে ধান কিনি। আর ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হতে পারবেনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ একজনের কাছ থেকে তিন টন ধান কিনি।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আরও বলেন- আমরা গত বছর সাত হাজার কৃষক কার্ড দিয়েছি। এবার আবার আপডেট করছি। আমরা ধানের দাম কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিয়ে থাকি। ফলে কোনো দালাল বা ফড়িয়ার এখানে কিছু করার সুযোগ নেই।

কৃষকদের নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষকেরা বলছেন, যারা দালাল বা প্রভাবশালী তাদের সবার কৃষক কার্ড আছে। কারণ তারাও কৃষি জমির মালিক। শুধু তাই নয় তারা কৃষকদের কাছ থেকেও কৃষক কার্ড নিয়ে নেয়। তারা আসলে অর্থের বিনিময়ে সব পক্ষকে ম্যানেজ করে। আবার সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে কৃষক কার্ড দখলে রাখে।

স্থানীয় যারা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী আছেন তাদের সঙ্গে দালালরা মিলে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কৃষকদের কেন্দ্রে যেতে দেয়না। আগেই তাদের ধান নিয়ে নেয় কম দামে। আর কেউ যদি যেতেও পারে আদ্রতাসহ নানা অজুহাতে তার ধান কেনা হয়না। সরকারি খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের অসাধু নিবিড় সম্পর্ক আছে।

বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনা বা আর্দ্রতা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়না। দেশে মোট কৃষকের ছয় শতাংশ বড় কৃষক। তারা হয়তোবা কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করতে পারে। কিন্তু, ছোট-ক্ষুদ্র বা বর্গা চাষির পক্ষে সম্ভব হয়না। সরকার ধানের যে বাড়তি দাম দিচ্ছে তা তারা পায়না। পায় দালাল ও প্রভাবশালীরা। আর ছোট কৃষকরা ধান ধরেও রাখতে পারেনা। কারণ তাদের অর্থ প্রয়োজন। কৃষকেরা যদি সংগঠিত হতে পারত তাহলে এই অবস্থার অবসান ঘটত।

খাদ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, আসলে দালাল এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সিন্ডিকেট করে। ফলে অনেক প্রকৃত কৃষক কেন্দ্র পর্যন্ত আসতে পারেন না। কিন্তু, এটা তো আমাদের এখতিয়ারে নেই। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। যারা দালাল তাদেরও কৃষি কার্ড আছে। আর দাললরা তো সংঘবদ্ধ।

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, এবার আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নিয়ে কৃষকের বাড়ি বাড়ি যাওয়া হবে। যদি দেখা যায় তা ১৪ ভাগের বেশি হয় তাহলে তাদের ধান শুকিয়ে সঠিক পর্যায়ে এনে তারপর কেনা হবে। যাতে তারা আর্দ্রতার ফাঁদে না পড়েন।
এর জবাবে খাদ্য অধিদপ্তরের ধান-চাল সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এটা আমাদের কাজ নয়। আমাদের অত জনবল নাই। এটা কৃষি বিভাগের ব¬ক সুপারভাইজারদের করার কথা। তারা করছে কিনা আমার জানা নাই।

কৃষকেরা দালাল ও ফড়িয়াদের দাপটে সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারছেনা এই অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, কেন্দ্রগুলো কৃষকদের ধান কেনার জন্যই। তাদের কাছ থেকেই আমরা ধান কিনছি। তাদের কাছ থেকে ধান কেনায় কোনো বাধা নাই। তারা কোথাও বাধা পেয়ে বা চাপের কারণে কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করতে পারেননি এরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নাই।

তিনি জানান, উপজেলা পর্যায়েই ধান কেনা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে অল্প কিছু ক্রয় কেন্দ্র আছে।

আপডেট সংবাদ পেতে শতাব্দীর কন্ঠ পড়ুন, শেয়ার করে সাথে থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
All rights reserved © Shatabdir Kantha . Developed by SDTT Academy & Tech Liberty