মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২২ পূর্বাহ্ন

তাড়াইলে বিলুপ্তির পথে প্রাকৃতিক শিল্পীপাখি বাবুই

রুহুল আমিন, প্রতিনিধি, তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ)
  • Update Time : বুধবার, ২২ মে, ২০২৪
  • ১৪৯ Time View

প্রতিনিধি, তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) : কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে বিলুপ্তির পথে বাবুই পাখির বাসা। একসময় উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামের আনাচে-কানাচে বাবুই পাখি ও তাদের বাসা চোখে পড়তো। আধুনিকতার ছোয়ায় প্রায় বিলুপ্তির পথে বাবুই পাখির শৈল্পিক প্রকৃতি দৃষ্টিনন্দন বাসা।

কবির ভাষায় ‘বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই।’ বাসা তৈরিতে যার নিপুণ দক্ষতা শিল্পের বড়াই সে করতেই পারে। কিন্তু কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী কবিতাটির নায়ক গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাবুই পাখি আজ বিলুপ্তির পথে।

তাল গাছের স্বল্পতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেই এমনটি হচ্ছে। একসময় গ্রাম্য বাড়ির বাইরের উঠানে তালগাছের পাতায় পাতায় দেখা যেত বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা। কিন্তু গ্রামের পথ ধরে অনেকটা পথ হাঁটলেও এখন বাবুই ও তার বাসা চোখে মেলা ভার।

বাবুই সাধারণত খড়, ঝাউ, তালপাতার আঁশ ও কাশবনের আঁশ দিয়েই উঁচু তাল গাছের ডগায় ঝুলন্ত পাতায় এবং খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাসা বানাতে বাবুই খুবই পরিশ্রম করে থাকে। ঠোঁট দিয়ে বনজাতীয় ঘাস ও কাশবনের চিকন চিকন আস্তরণ দিয়ে বাসা বুনে বাবুই। বাসা পেট দিয়ে ঘষে অর্থাৎ পলিশ করে মসৃণ করে থাকে। শক্ত বুননের সাথে শিল্পের অনন্য সমন্বয় বাসাকে দেখতে খুব সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তোলে। এতটাই মজবুত যা প্রবল বাতাসেও ছিঁড়ে পড়ে না।

বুলবুল আহম্মেদ রচিত ‘পাখিদের জীবন কথা’ বইয়ে বাবুই পাখির বাসা তৈরি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য দেয়া আছে। বাসা তৈরির শুরুতে বাসার নিম্নমুখে দু’টি গর্ত থাকে। কিন্তু বাসা তৈরি সম্পূর্ণ হলে এক দিকের গর্ত বন্ধ করে তাতে ডিম রাখার স্থান তৈরি করে। আর অপর দিকটি লম্বা করে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ তৈরি করে।

বাসা তৈরির কাজের একপর্যায়ে পুরুষ বাবুই পাশের বাবুইয়ের বাসায় গমন করে সঙ্গীর খোঁজে। সঙ্গী পছন্দ হলে পুরুষ বাবুই পাখি স্ত্রী বাবুই পাখিকে সঙ্গী বানানোর জন্য ভাব-ভালোবাসা নিবেদন করে। সেই সাথে বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হতেই স্ত্রী বাবুইকে বাসাটি দেখায়। কারণ বাসা পছন্দ হলেই কেবল স্ত্রী বাবুই সম্পর্ক গড়ে তোলে।
স্ত্রী বাবুই পাখির বাসা পছন্দ হলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুই পাখির সময় লাগে মাত্র চার থেকে পাঁচ দিন।

স্ত্রী পাখির প্রেরণায় পুরুষ বাবুই পাখি মনের আনন্দে বিরামহীনভাবে বাসা তৈরির কাজ শেষ করে। একটি পুরুষ বাবুই পাখি একটি মৌসুমে প্রায় পাঁচ থেকে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। তবে প্রেমিক বাবুই পাখি যতই ভাব-ভালোবাসা প্রকাশ করুক না কেন প্রেমিকা বাবুই পাখি ডিম দেয়ার সাথে সাথে প্রেমিক বাবুই আবার সঙ্গী খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সাধারণত দেশী, দাগি এবং বাংলা এই তিন প্রজাতির বাবুই-এর দেখা যেতো আমাদের দেশে। তার মধ্যে দাগি এবং বাংলা বাবুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে দেশী বাবুই এখনো কিছু কিছু চোখে পড়ে।

মাত্র ১৫-১৬ বছর আগেও গ্রামের তালগাছে চোখে পড়ত বাবুই পাখির বাসা। গোশত সুস্বাদু বলে শিকারিদের সেরা তালিকায় বাবুই। নির্বিচারে তালগাছসহ বাবুই পাখির বাসা বানানোর গাছ কাটায় বসবাস উপযোগী পরিবেশ কমছে। কীটনাশকের অবাধ ব্যবহার, শিকারিদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবেই আজ এসব পাখি বিলুপ্তির পথে বলে ধারণা গবেষকদের।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, শুধু বাবুই পাখির শৈল্পিক নিদর্শন টিকিয়ে রাখতে নয়, বরং আমাদের পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতেই বাবুইকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশ থেকে বাবুইসহ অন্যান্য প্রাণী ও পাখি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে পরিবেশও যে দিন দিন মানুষের জন্যে অনুপযোগী হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তাড়াইল উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. নুরজাহান বেগম বলেন, এখনো কিছু জায়গায় বাবুই পাখিসহ অন্যান্য পাখি দেখা যায়। তবে সবাইকে নিজ এলাকার বিষয়ে সচেতন হতে হবে। তাহলেই কেবল বাবুইসহ অন্য পাখি ও প্রাণি সংরক্ষণ সম্ভব।

আপডেট সংবাদ পেতে শতাব্দীর কন্ঠ পড়ুন, শেয়ার করে সাথে থাকুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
All rights reserved © Shatabdir Kantha . Developed by SDTT Academy & Tech Liberty