রুহুল আমিন, তাড়াইল, প্রতিনিধি (কিশোরগঞ্জ) : দিগন্ত বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে ঢেউ খেলানো পাকা সোনালি বোরো ধান কাটা শেষ করেছে কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কৃষকেরা।
আকাশে ছুটন্ত মেঘের ভেলা, পাখির কলতান, সারি সারি কুঁড়েঘর, হাওরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নরসুন্ধা নদীতে রাজহংসের জলকেলি ও শিশুদের দুরন্তপনায় চিরন্ত বাংলার প্রকৃতির রূপ যেন আছড়ে পড়েছিল হাওরাঞ্চলে। বোরো ধান কাটার মৌসুমে প্রকৃতি যেন সেখানে স্বরুপে জেগে উঠেছিল। এবার অনাবৃষ্টি ও অকাল বন্যা না হওয়ায় স্বস্তিতে বোরো ধান গোলায় তুলতে পেরেছে উপজেলার কৃষকেরা।
সরেজমিনে শনিবার (২৫ মে) দেখা যায়, উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ১০ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ হেক্টর বেশি জমিতে। অর্থাৎ ১০ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে। বাজারে যেমন উঠতে শুরু করেছে নতুন ধান তেমনি কমতে শুরু করেছে ধানের দাম।
এক মণ ধানের মূল্যে মিলেছে একজন শ্রমিক। দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি এবং কৃষি শ্রমিকের মুজুরি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কৃষকের। তাছাড়া চলতি মৌসুমে নদী-নালায় পানি না থাকা সেচেও বেশি খরচ হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। কৃষকদের দাবি সরকার ঘোঘিত ৩২ টাকার স্থলে ৩৫ টাকা কেজি দরে ধান খরিদ করলে কিছুটা লাভের মুখ দেখা যেতো।
উপজেলার বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান বাজারে ভিজা ধানের দাম ভালো। প্রতি মণ ধান ১০৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় কয়েকজন কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ধান কাটা ও খলায় পৌঁছানো পর্যন্ত পারিশ্রমিক হিসেবে শ্রমিকদের ১০% থেকে ১২% ধান দিতে হয়েছে। অর্থাৎ ১০০ বস্তা ধানের জন্য দেয়া হয় ১০-১২ বস্তা। আবার ধান মাড়াইয়ের জন্য ১০০ বস্তায় দিতে হয় ৫-৭ বস্তা। নগদ টাকায় ধান কাটলে দিতে হয় ৯০০-১০০০ টাকা। প্রকারভেদে অর্থাৎ দূরের জমি থেকে কেটে আনলে দিতে হয় জন প্রতি ১২শ’ টাকা প্রতি দিনের মুজুরি।
এছাড়া জমিতে চারা রোপন, সার, কীটনাশক দেয়ায় প্রচুর খরচ করতে হয়। আরও থাকে স্থানীয় মহাজনদের নিকট আগাম টাকা নেয়া যা ধান কাটার পর দ্বিগুণ থেকে তিনগুন টাকা ফেরৎ দিতে হয়। তাই বোরো ধান কাটার পর ভালো দাম পেলে কৃষকদের গোলায় সারা বছরের খাদ্য মজুদ করে রাখা সম্ভব হয়। ন্যয্যমূল্য না পেলে কৃষকদের গোলায় সারা বছরের খোরাকের ধান রাখা সম্ভব হয় না।
উপজেলার তাড়াইল-সাচাইল ইউনিয়নের কালনা গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, এক বিঘা জমিতে উৎপাদিত ধানের মূল্যের সমান আমার খরচ হয়েছে। সরকারের ঘোষিত ৩২ টাকার পরিবর্তে ৩৫ টাকা কেজি দরে ধান খরিদ করলে আমরা একটু লাভের মুখ দেখতে পারতাম। তাছাড়া খাদ্য গুদামে আমাদের মতো কৃষকেরা ধান দিতে পারি না কখনও। এক শ্রেণির লোক ওখানে সুবিধা পায়। ওইসব সুবিধাভোগী লোকদের সুবিধা দিতে পারলেই ধান দেয়া যায় খাদ্যগুদামে। একই সুরে কথা বলেন তাড়াইল-সাচাইল ইউনিয়নের সহিলাটি গ্রামের কৃষক সাহাব উদ্দিন এবং কালনা গ্রামের কৃষক ফজলুর রহমান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সুমন কুমার সাহা জানান- খরা, কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টিতে এ বছর বোরো ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। তাছাড়া সেচ, সার সরবরাহ ও কৃষি উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কৃষিনির্ভর উপজেলায় মানুষ একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। তাই বোরো ধান তোলার সময় কৃষক পরিবারের সব সদস্য মিলে আনন্দের মধ্য দিয়ে গোলায় ধান তুলেছেন।