শতাব্দী ডেস্ক : গ্রামে লেগেছে শহরের ছোঁয়া। গ্রামগুলোতে বিরাজ করছে শহুরে আবেশ। মাটির রাস্তার পরিবর্তে পিচঢালা পাকা রাস্তা, গ্রামের রাস্তার দুধারে শহরের মতো জ¦লে সড়ক বাতি, ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো, খেয়াঘাটের পরিবর্তে ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন গ্রামীন জনজীবনে এনে দিয়েছে অন্য রকম পরিবর্তন। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে ‘দূর’ হয়েছে ‘নিকট’। বদলে গেছে চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। গ্রামে মাটির দেয়ালে গাঁথা জোড় বাংলাঘর এখন আর দেখা মেলে না। দেখা মেলে না গোলপাতায় কিংবা খড়ে ছাওয়া মাটিরঘর। বাড়ির সামনে সেই বৈঠকখানাও এখন বিলুপ্ত।
চিরচেনা গ্রামও এখন অচেনা লাগে। শান্তির নীড় হিসেবে বহুল পরিচিত মাটির ঘরের স্থান দখল করেছে ইট-পাথরের উঁচু দালান-কোঠা। গরিবের এসি বলে সুপরিচিত মাটির দেয়ালে গাঁথা বাংলাঘর এখন বিলুপ্তির পথে। সাতচালা কিংবা আটচালা মাটির বাংলাঘর এখন আর নজরে পড়ে না। আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের আবর্তে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী মাটির তৈরি এসব ঘর আগের মতো এখন আর তেমন একটা নজরে পড়ে না। সাতক্ষীরার প্রবীন সাংবাদিক ও নাগরিক নেতা অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, আশির দশকেও গ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি দেখা যেত। নব্বইয়ের দশকেও অতীতের সাক্ষী হিসেবে গ্রামে দেখা যেত জোড় বাংলাঘর। সাতক্ষীরা জেলার ৭৮টি ইউনিয়নের প্রত্যেক গ্রামে মাটির ঘর ছিল।
ইট-পাথরের তৈরি পাকা দালানের সংখ্যা ছিল গ্রামে হাতেগোনা। সেই দিন বদলে গেছে। এখন হাতেগোনা দু’একটি মাটিরঘর দেখা যায়। অধিকাংশ বাড়ি এখন ইট পাথরের তৈরি। জানা যায়, এঁটেল মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হত। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালের উপর কাঠ বা বাঁশের চাল তৈরি করে খড়-কুটা,গোলপাতা, টালী, অথবা ঢেউটিন দিয়ে ছাওয়া হতো। মাটি কুপিয়ে ও পানি দিয়ে কাদায় পরিণত করার পদ্ধতিকে স্থানীয় ভাষায় ‘জাব’ বলা হয়। ‘জাব’ কেটে তা সুচারুভাবে গেঁথে ভাজে ভাজে তৈরি করতে হয় দেয়াল। দেয়ালের একেকটি ভাজের পুরুত্ব তিন থেকে চার ফুট। এভাবে পাঁচ থেকে ছয়টি ভাজ শেষ হবার পর দেয়ালের উচ্চতা দাঁড়ায় ১৫-১৮ ফুট। যিনি মাটির চাপ গেঁথে দেয়াল ও বাঁশ দিয়ে চাল তৈরি করেন তাকে ‘ঘরামি’ বলা হয়। ঘরের বারান্দা ও চালের ধরণের উপর ভিত্তি করে ঘর বিভিন্নভাবে তৈরি হয়। চারপাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে ‘আটচালা’ এবং তিনপাশে বারান্দা বিশিষ্ট ঘরকে ‘সাতচালা’ ঘর বলা হয়। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আলপনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। শৈল্পিক আলপনায় ফুটে উঠত নিপুণ কারুকার্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে এখন উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। একসময় সাতক্ষীরার বিভিন্ন গ্রামে অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেও প্রবল বর্ষণে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে এখন কাঁচা ঘর ফেলে পাকাঘর নির্মাণের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। কবি ও সাহিত্যিক সৌহার্দ সিরাজ বলেন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে ‘দূর’ হয়েছে ‘নিকট’। বদলে গেছে চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। গ্রামে মাটির দেয়ালে গাঁথা জোড় বাংলাঘর এখন আর দেখা মেলে না। দেখা মেলে না গোলপাতায় কিংবা খড়ে ছাওয়া মাটিরঘর। বাড়ির সামনে সেই বৈঠকখানাও এখন বিলুপ্ত। চিরচেনা গ্রামও এখন অচেনা লাগে।
শান্তির নীড় হিসেবে বহুল পরিচিত মাটির ঘরের স্থান দখল করেছে ইট-পাথরের উঁচু দালান-কোঠা। ভ‚মিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির ঘর শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। কিন্তু কালের আবর্তে দালান-কোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির দেয়ালে গাঁথা জোড় বাংলা ঘর। ইট-পাথরের নগরীতে এমনই বিলুপ্তপ্রায় মাটির তৈরি ঘর দেখলে মনে হয়-‘আমি তো এসেছি আউল বাউল মাটির দেউল থেকে।