আবু হানিফ, পাকুন্দিয়া প্রতিনিধি : কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া ইউনিয়নের বড় আজলদী গ্রামের শতবর্ষী বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক, এখনো পান ব্রিটিশ সরকারের ভাতা। বয়োজ্যেষ্ঠ এই মানুষটি এখনো স্বরণ করেন অতীতের দিনগুলোর কথা। লেখাপড়া না জানা থাকলেও ইংরেজি এবং হিন্দিতে কথা বলতে পারেন। এখনো চশমা ছাড়াই পড়তে পারেন পত্রিকা ও বইপত্র। এলাকায় মিলিটারি হিসেবে পরিচিত তিনি।
বড় আজলদী গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল মান্নান। জন্ম ১৯২০ সালের ১৬ নভেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে থেকে অংশ নেন এই বীর যোদ্ধা। ব্রিটিশ ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশ এই তিন দেশের নাগরিক হবার অনন্য গৌরবের অধিকারী শতবর্ষী আব্দুুল মান্নান নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করছেন তিনটি ভিন্ন শাসনব্যবস্থা। দীর্ঘদিন ধরে আঁকড়ে রেখেছেন বীরত্বের স্বীকৃতি স্বারক কয়েকটি মেডেল ও পোশাক।
জানা গেছে, আব্দুল মান্নান ১৯৪২ সালে বৃটিশ-ভারতের বেসরকারি সোলজার হিসেবে অংশ নেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। পাকিস্তান-চীন সীমান্তবর্তী হাসানাবাদ এলাকায় এক মাসের ট্রেনিং শেষে ল্যান্সনায়েক হিসেবে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধে অংশ নেন ব্যাটালিয়ন ক্যাপ্টেন ড. গালিবের নেতৃত্বে। কয়েক হাজার সৈনিকসহ ছয় মাসের খাবার মজুত করে তাদের বহনকারী যুদ্ধ জাহাজ রওনা হয় কলম্বোর পথে।
অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ চারটা কামান বিভিন্ন দিকে তাক করা। টানা একমাস রাত-দিন আটলান্টিক মহাসাগরে জাহাজটি অংশ নেয় পানিপথের যুদ্ধে। এক মাস পর কলম্বোর কাছাকাছি পৌঁছে হিটলারের একটি জাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে হায়দ্রাবাদ নিয়ে আসা হয় তাদের। পানিপথের যুদ্ধের পর করাচি থেকে চলে যান মিয়ানমার। মিয়ানমার আসার পর হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপ করা হয়। আর তখনই মূলত শেষ হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
শত বছর ধরে সযতেœ আলগে রাখা বিভিন্ন ব্যাচ লাগানো সৈনিকের পোশাক গায়ে জড়িয়ে যুদ্ধের কাহিনী শোনান আব্দুল মান্নান।
যুদ্ধ শেষে সামান্য টাকা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয় আব্দুল মান্নানকে। কিন্তু এরপর আর খবর নিচ্ছিলো না ব্রিটিশ সরকার। এতে ক্ষুব্ধ হন তিনি। চিঠি লিখেন ব্রিটেনের রানির কাছে। তার চিঠির জবাবও দেন রানি। এরশাদ সরকারের সময় ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয় তার সঙ্গে। সেই থেকে সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডের মাধ্যম তাকে নিয়মিত বিভিন্ন অনুদান দিচ্ছে ব্রিটিশ সরকার। তবে যুদ্ধের সময় পাওয়া মেডেলগুলোই তার কাছে মহামূল্যবান বলে জানালেন লেন্সনায়েক আব্দুল মান্নান। লেখাপড়া না জানলেও ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন।
ব্রিটিশ সৈনিক আব্দুল মান্নান জানান, যুদ্ধ করে তিনি তেমন কিছু পাননি। তবে ব্রিটেনের রানি তার চিঠির জবাব দিয়েছেন। তার সংগ্রহে আছে বীরত্বের স্বীকৃতিসরূপ কয়েকটি মেডেল ও পোশাক। এটিই তার কাছে সবচেয়ে বড় পাওনা। যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে একটি সরকারি চিনিকলে নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি নেন আব্দুল মান্নান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই চিনিকলে গোপনে অস্ত্রের ট্রেনিং দেন কর্মচারীদের। তবে ব্রিটিশ এ যোদ্ধাকে কখনই দেওয়া হয়নি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি। পাননি দেশের হয়ে কোনো সরকারি মর্যাদা।
বর্তমানে তার দুই স্ত্রী ও ১১ ছেলে-মেয়ে রয়েছে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেই সময় কাটান তিনি। বয়স এতো বেশি হলেও এখনো খালি চোখে সবকিছু দেখতে পান। সময় পেলেই লোকজনকে শোনান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী।