কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মাসুদুর রহমান একটি ওষুধের দোকান চালাচ্ছিলেন। নরসিংদীর লিটন মিয়ার সার্কাসের হাতি লালন করেন গোপালগঞ্জ সদরের মাহুত বাবুল শেখ (২৫)। গত ১ জুলাই সোমবার সন্ধ্যার দিকে হাতি নিয়ে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের নগুয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় যান। সেখানে দোকানে দোকানে চাঁদা তুলছিলেন। এ সময় এ আর ফার্মা নামে ওষুধের দোকানে গেলে মালিক মাসুদুর রহমান (৪৫) হাতির শুঁড়ের মাথায় ১০ টাকার একটি নোট দেন।
টাকা নিয়ে হাতি চলে যাচ্ছিল। তখন হাতি দেখে দু’জন নারী ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওষুধের দোকানে ঢুকে পড়েন। এ সময় মাসুদ দোকানের শাটার নামাতে গেলে তখন হাতি শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে সজোরে আঘাত করে মাসুদুরকে বাইরে ফেলে দেন। তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন। গুরুতর আহত অবস্থায় মাসুদকে চিকিৎসার জন্য শুরুতে কিশোরগঞ্জ ও পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
কিন্তু তার অবস্থা গুরুতার হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেস্টা করেও তাকে আর বাঁচাতে পারেনি। মাসুদ মারা যান। এ ঘটনায় হাতির মাহুতকে আটক করা হয়েছে। হাতিটি হেফাজতে নিয়েছে প্রশাসন। সাধারণভাবে বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে কোনো বন্যপ্রাণী আটক বা লালন করা যায় না। তবে কোনো কোনো প্রাণী বিশেষ কারণে শর্তসাপেক্ষে পালন করার অনুমতি দিলেও শর্তের বাইরে একে ব্যবহার করা যাবে না।
যদি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শর্ত ভঙ্গ করে তবে তা হবে দণ্ডনীয় অপরাধ। হাতি পালনের অনুমতি দেওয়া হলেও একে দিয়ে চাঁদা আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয় না। দেশের প্রচলিত আইনে চাঁদাবাজীও একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এ যা বলা আছে- আবদ্ধ প্রাণী, বন্যপ্রাণী, ট্রফি ইত্যাদির লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে-
২৪ (১) কোন ব্যক্তি কোন বন্যপ্রাণী অথবা উহার দেহের অংশ, মাংস, ট্রফি, অসম্প‚র্ণ ট্রফি বা তফসিল ৪ এ উল্লেখিত কোন উদ্ভিদ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষ, আহরণ, উৎপাদন, লালন-পালন, আমদানি-রপ্তানি অথবা কোন বন্যপ্রাণী শিকার করিতে চাহিলে, প্রধান ওয়ার্ডেন বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার নিকট হইতে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে এবং ফি প্রদান সাপেক্ষে লাইসেন্স গ্রহণ করিতে হইবে।
(২) এই আইন কার্যকর হইবার প‚র্বে কোন ব্যক্তি কোন বন্যপ্রাণী অথবা উহার দেহের অংশ, মাংস, ট্রফি, অসম্প‚র্ণ ট্রফি বা তফসিল ৪ এ উল্লিখিত কোন উদ্ভিদ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উৎপাদনপ‚র্বক মজুত করিয়া রাখিলে এই আইন কার্যকর হইবার ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে উপ-ধারা (১) এর বিধান অনুযায়ী লাইসেন্স গ্রহণ করিতে হইবে।
(৩) উপ-ধারা (২) এর অধীন আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধান ওয়ার্ডেন বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা যথাযথ পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়া সন্তুষ্ট হইলে মজুতকৃত বন্যপ্রাণী অথবা উহার দেহের অংশ, মাংস, ট্রফি, অসম্প‚র্ণ ট্রফি বা তফসিল ৪ এ উলি¬খিত উদ্ভিদে সনাক্তকরণ চিহ্ন প্রদান করিবেন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে লাইসেন্স প্রদান করিবেন।
(৪) লাইসেন্সের মেয়াদ প্রদানের তারিখ হইতে ১ (এক) বৎসর পর্যন্ত বহাল থাকিবে।
(৫) বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে এবং ফি প্রদান সাপেক্ষে লাইসেন্স নবায়ন করিতে হইবে।নবম অধ্যায় ৩৬/ (২) বলা আছে কোন ব্যক্তি ধারা ১০ এর অধীন পারমিট গ্রহণ না করিয়া তফসিল ১ এ উল্লেখিত কোন বাঘ বা হাতির ট্রফি, অসম্প‚র্ণ ট্রফি, মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করিলে, দখলে রাখিলে বা ক্রয় বা বিক্রয় করিলে বা পরিবহন করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ৩ (তিন) বৎসর পর্যন্ত করাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ৩ (তিন) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডিত হইবে।
আলোচনায় এসেছে আক্রমণকারী হাতি, নিহত মাসুদ ও হাতি পরিচালনাকারী মাহুত। সে বিবেচনায় মাসুদের মৃত্যুর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হাতিকে জব্ধ করেছে, মাহুতকে পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। তবে ঘটনার বিশে¬ষণে এ কথা স্পষ্ট যে হাতির মালিক কিন্তু মাহুত নয়। এটি একটি সার্কাসের হতি। সার্কাসের মালিককে এখনও আইনের আওতায় আনা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ হাতি দিয়ে শুধু কিশোরগঞ্জ নয় বরং সারাদেশে গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে এভাবেই চাঁদাবাজী করা হয়। হাতির পিঠে বসে থাকা লোকটিকে মহুত বলা হয়, সে হাতিকে পরিচালিত করে। এ ছাড়াও মাহুতের কাজে ও হাতির প্রয়োজনে চাঁদা তুলার কাজে হাতি যখন লোকালয়ে আসে তখন আরও দুই তিন জন লোক থাকে। তারা সব সময় হাতির পেছনে পেছনে থাকে। এদের কাওকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।
বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন ২০১২’র বাস্তবায়নে সরকারের যেসকল দপ্তর দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের এ ক্ষেত্রে কোন প্রকার শৈতিল্য আছে কি না এ বিষয়ে সুষ্ঠ তদন্ত করে সঠিক বিচার হবে এমনটা আশা করা স্বাভাবিক। তবে শিক্ষিত মাসুদ জীবনের তাগিদে ফার্মেসি ব্যবসা করে সংসার চালাতো। আজ মাসুদ নেই, কে চালাবে মাসুদের সংসার? মাসুদের এতিম শিশুরা যখন অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করবে তখন কী জবাব দেবে সমাজ, কী জবাব দেবে রাষ্ট্র। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ শহরের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাসুদের এই নির্মম হত্যাকাÐ। সকলের প্রত্যাশা এ ঘটনার সাথে জড়িতরা দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তি পাবে। মাসুদের পরিবার পাবে যথাযথ ক্ষতিপ‚রণ।