বিশেষ প্রতিনিধি, হবিগঞ্জ : ৪ ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম ‘বানিয়াচং’। গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবরে সারাদেশের ন্যায় বানিয়াচংয়ের বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে ছাত্র জনতার শতঃস্ফুর্ত বিজয় মিছিল শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকে। এক পর্যায়ে গুজবের প্রেক্ষীতে ছাত্র-জনতার একটি মিছিল থানা অভিমুখে চলে যায়। তখন থানার সামনে বানিয়াচং-হবিগঞ্জ সড়ক পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নেয়। মুর্হুমুহু গুলির আওয়াজ শুনে হাজার হাজার নারী-পুরুষ থানার চতুর্দিকে জড়ো হতে থাকে এবং পুলিশের গুলিতে হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। মধ্য রাতে সেনাবাহিনী গিয়ে সংঘর্ষ থামায়।
সেনাবাহিনী আটকে পড়া সকল পুলিশ অফিসার ও জোওয়ানদের হবিগঞ্জ নিয়ে যেতে পারলেও গণপ্রতিরোধে দারোগা সন্তোষ চৌধুরীকে থানায় ফেলে যেতে বাধ্য হয়। ঘটনাস্থলে ৯ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। তন্মধ্যে উত্তেজিত জনতার গণপিটুনীতে ঘটনাস্থলে ২ জন এবং পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১ জনের মৃত্যু হয়। ‘মহাগ্রাম বানিয়াচং’র ইতিহাসে ৭৯ বছর পর গত ৫ আগষ্ট ১০ জন নিহত হওয়ার ২য় ঘটনা ঘটে। ইতোপূর্বে ১৯৪৫ সালে চতুর্দিক গড়ের খাল (পরিখা) বেষ্টিত বানিয়াচঙ্গের অভ্যন্তরে জনসংখ্যার দু’তৃতীয়াংশ কালাজ্বর/ম্যালেরিয়া নামীয় মহামারীতে মারা গিয়েছিল।
৯ আগষ্ট বানিয়াচং উপজেলা সদরের বিভিন্ন মহল্লায় নিহতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে সমবেদনা ও সাহায্য সহযোগিতার অঙ্গীকার করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন বানিয়াচঙ্গের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী মমিন। শহীদদের মধ্যে ৩টি পরিবার ব্যতিত অন্যান্যরা টিনের কাঁচা কুড়েঘরে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ৫৩ বছর পর দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জনে ১০ জনের প্রাণহানী হয়েছে, আহত শতাধিক। শোকাহত ও হতাহতের পরিবারকে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে মানবিক সাহায্য সহযোগিতার আহবান জানান তিনি।
নিহতরা হলেন- হাসাইন মিয়া (১২) পিতা ফেরিওয়ালা ছানু মিয়া, তোফাজ্জল হোসেন (২২) পিতা দিনমজুর আব্দুর রউফ মিয়া, আশরাফুল আলম (১৮) পিতা দিনমজুর আব্দুল নূর, মোজাক্কির মিয়া (৩৫) পিতা মৃত শমসের মিয়া, ছাদিকুর রহমান (৩০) পিতা মিশুক চালক দলাই মিয়া, আকিনুর রহমান (৩৩) পিতা তাহের আলী, শেখ নয়ন হোসেন (২০) পিতা আলী হোসেন, আনাছ মিয়া (২০) পিতা মৃত আবুল হোসেন, সোহেল আখঞ্জী (৪৩) পিতা মোঃ শাহিদ আহমদ এবং দারোগা সন্তোষ চৌধুরী (৩০) পিতা বিষ্ণুপদ চৌধুরী।
ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবরের সদস্যরা মানবেতর জীবন যাপান করছে। নিম্ন আয়ের এই শোকাহত পরিবারগুলো আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহŸান জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসী।
অর্থলিপ্সু সন্তোষ দারোগা বানিয়াচংবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ধনাঢ্য পরিবারের ছেলেদেরকে মাদক গুঁজে আলামত উদ্ধার, নিরীহদের আটক করে বিপুল অর্থ আদায়ের বাণিজ্যই ছিল তার প্রধান কাজ। অতি উৎসাহী আওয়ামী ক্যাডার হিসেবে পরিচয়দানকারী সন্তোষ দারোগার উদ্ধত্ব্য পূর্ণ আচরণ ও অপকর্মে বানিয়াচংবাসী ছিল চরম ক্ষুব্ধ ও অতিষ্ট। সেনাবাহিনী থানা থেকে সকল পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবলদেরকে শেষ রাতে উদ্ধার করতে পারলেও সন্তোষকে রেখে আসতে বাধ্য হয়। বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে সন্তোষ দারোগার মৃত্যু হয়।