আহসানুল হক জুয়েল : নিকলী উপজেলার জারইতলা ইউনিয়নের জারইতলা ২৫ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সেলিমের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার জারইতলা ইউনিয়নের জারইতলা ২৫ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯১১ সালে স্থাপিত হয়। শিক্ষক আসাদুজ্জামান সেলিম ২০১৪ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অত্র বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা চারজন। এর মধ্যে নারী শিক্ষকের সংখ্যা দুইজন।
সর্বমোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৩ উল্লেখ থাকলেও সরেজমিনে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। জানা গেছে, অনুপস্থিতির বিষয় নিয়ে বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার সন্দেহ ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এমন সত্যতা স্বীকার করলেও তাদের ভাষ্য প্রশাসনের তদারকির কারণে বিদ্যালয়টি এখনো ঠিকে আছে। পাশাপাশি সহকারী একাধিক শিক্ষকের প্রবল চেষ্টায় আর উপজেলা পর্যায় থেকে নিয়মিত মা সমাবেশে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করেছে বলে বিদ্যালয়টি এখনো ঠিকে আছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই বিদ্যালয়ে বিশেষ করে ছাত্রী শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকার চিত্র তুলে ধরেন অসংখ্য শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। মূলত প্রধান শিক্ষকের অনৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়কেই অন্যতম কারণ বলে অভিমত দেন সচেতন মহল, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা।
গত ২ ডিসেম্বর অত্র বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন অভিভাবক পঞ্চম শ্রেনির ছাত্রী যৌন নির্যাতন ও নির্যাতনের চেষ্টার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ তুলেন। এর মধ্যে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীর অভিভাবক তার মেয়েকে যৌন হয়রানির চেষ্টা করেছেন বলে প্রথমে মৌখিক অভিযোগ তুলেন। পরবর্তী পর্যায়ে তার মা বাদী হয়ে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেন নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা বরাবর।
এ ঘটনার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্র বিষয়টি বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি প্রধান শিক্ষককে শোকজ করেছেন বলেও নিশ্চিত করেন। এই ঘটনার পর থেকে শিক্ষক আসাদুজ্জামান সেলিম বিদ্যালয় থেকে ছুটিতে রয়েছেন বলে জানান কর্তৃপক্ষ।
আরো জানা গেছে বিদ্যালয়ে চারজন শিক্ষকের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী দুজনের বাড়ি বিদ্যালয়ের সীমানা সংলগ্নে। এরা হলেন- সহকারী শিক্ষক এমদাদুল হক জুয়েল ও তার স্ত্রী সাওদীয়া সুলতানা। অপর একজন একই ইউনিয়নের কাছাকাছি এলাকার ধারীশ্বর গ্রামের খাদিজা আক্তার জেনী।
সহকারী শিক্ষক এমদাদুল হক জুয়েলের কাছে সাংবাদিকরা কথা বললে তিনি জানান- দীর্ঘ ১১ বছর ধরে প্রধান শিক্ষক এহেন অনৈতিক অপরাধ করে আসছেন। তারা কেন এতো দিন মুখ খোলেননি? এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান।
সহকারী শিক্ষক সাওদীয়া সুলতানাসহ সকল শিক্ষকের বিরুদ্ধে গুঞ্জন রয়েছে, তারা প্রধান শিক্ষকের নানা রকমের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ রেখে তারাও নানা অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। যে কারণে স্কুলটির এই দুরবস্থা। যদিও সহকারী শিক্ষক বৃন্দ তাদের ব্যর্থতার দায় সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। বরং শিক্ষকরা এলাকার অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করেন।
শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, বিদ্যালয়টি ৫ আগষ্ট রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকে বর্তমানে এডহক কমিটি দ্বারা পরিচালিত চালিত হচ্ছে। এডহক কমিটির সভাপতি উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা অফিসার নাসিমা বেগম।
পুরো এলাকায় প্রধান শিক্ষকের ছাত্রী যৌন হয়রানির কথা জানাজানি হলে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে গেলে ৫ম শ্রেণির ছাত্র শাহীনের মায়ের ভাষ্যমতে- তার ছেলে ছোট বোন লামিয়াকে এই বিদ্যালয়ে পড়াতে মানা করে। কারণ জানতে চাইলেও সহজে বলতে নারাজ, লজ্জা পায়। তার পর বিষয়টি সন্দেহ হলে এলাকার অন্য শিশুদের জিজ্ঞেস করলেই প্রধান শিক্ষকের চরিত্র ভালো না বলে জানায়। তারপর মা রিমা আক্তার নিজে বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ তোলেন সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে। এ সময় প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান সেলিমের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করলে প্রধান শিক্ষক কোন জবাব দিতে পারেননি। মুখ চুপসে যান বলে এলাকাবাসী এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন।
এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণির একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে একই আচরণের অভিযোগ ওঠেছে। উক্ত বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির বেশ কয়কজন ছাত্রীও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনৈতিক আচরণের সত্যতা তোলে ধরেন।
অভিযোগকারীর স্বামী জারইতলার ফরহাদ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন- শিক্ষকদের আলাদা টয়লেট থাকা সত্ত্বেও কেন তিনি ছাত্রীদের টয়লেটে নিয়মিত ডুকে যান। এ ধরণের অশ্লিলতার কঠিন বিচারের দাবি জানান। এছাড়ও প্রধান শিক্ষক নিজের মোবাইল থেকে প্রায়ই বালিকাদের অশ্লিল ভিডিও দেখাতেন বলে ছাত্রীদের কাছে শুনেছেন। তবে লোক লজ্জা ও মান সম্মানের দিকে তাকিয়ে তিনি এতো দিন কিছু বলেননি বলে জানান।
প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান সেলিমের সাথে মুঠোফোনে এ বিয়য়ে কথা হলে অভিযোগকে তিনি একটি মহলের ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন। তবে তার মুঠোফোনে অশ্লিল ভিডিওর সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার কথা জানালে জবাবে বলেন- বিদ্যালয়ের সব ছাত্রীরা মিলে তার সরলতার সুযোগ নিয়ে অনুষ্ঠানের অজুহাতে হলুদিয়া পাখির ভিডিও ডাউনলোড করার কথা বলে ছাত্রীরা অশ্লীল ভিডিও ডাউনলোড করে দিয়েছেন। এ সময়ে তিনি টয়লেটে ছিলেন বলে দাবি করেন।
অপরদিকে ছাত্রীদের টয়লেটে ঢুকে পড়ার বিষয়ে বলেন, একমাত্র কমোড টয়লেট পরিষ্কার আছে কি না তা দেখতেই গিয়ে ছিলাম। অপর টয়লেট থেকে ছাত্রী চিৎকার দেয়ার বিষয়টিকে ভয়ে এমনটি হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি অশ্লীল কিছু করেননি বলে দাবি জানান।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সৈয়দা মোহসীন সোবহান এই বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত আছেন বলে জানিয়েছেন। তবে তিনি বর্তমানে ট্রেনিংয়ে থাকলেও উপর মহলে এ নিয়ে তার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে বলে জানান। পাশাপাশি ক্লাস্টারের দায়িত্ব নাসিমা আক্তারকে দিয়েছেন বলেও জানান।
উপজেলা সহকারি শিক্ষা অফিসার নাসিমা আক্তারের সাথে এই বিষয়ে কথা হলে তিনি প্রাথমিক আলামত পর্যবেক্ষণ শেষে অভিযোগটি উপর মহলে পাঠিয়েছেন বলেও জানান। তবে অপরাধী যেই হোক অভিযোগ প্রমাণিত হলে শিক্ষা বিভাগের বিধি অনুযায়ী অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।
জেলা শিক্ষা অফিসার মজিব আলমের সাথে এই বিষয়ে কথা হলে তিনি অভিযোগের বিষয়টি ঢাকাস্থ উপর মহলে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। পাশাপাশি কেউ এ ধরণের আচরণ করলে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এই বিষয়েও তার কোন আপত্তি নেই বলে জানান। অপরাধ প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তিরও দাবি জানান।
নিকলী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে বলে জানান। এই বিষয়ে তদন্তপূর্বক ঘটনার প্রমাণ সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান।