প্রতিনিধি নিকলী, আব্দুর রহমান রিপন : কালের বিবর্তনে এক সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পণ্য গুরুত্ব হারিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তেমনি নিকলীর ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। ভালো নেই এ এলাকার মাটির কারুশিল্পীরা। প‚র্ব পুরুষের পেশা ইতিমধ্যেই ছেড়েছেন অনেকেই, নেই সরকারি তেমন পৃষ্ঠপোষকতা, সংকট তৈরি হয়েছে এ কাজের কাঁচামাল এঁটেল মাটির, ঋণ চাইলেও সাড়া দেয় না সরকারি ব্যাংক, বেসরকারি সংস্থাও নিয়েছে মুখ ফিরিয়ে। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে শ‚ন্যতা।
প্রাচীন সভ্যতার অপ‚র্ব উপকরণ মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। পুরুষ ও নারীর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধরণের সৌখিন সামগ্রী। এই মৃতশিল্পীরা জনসাধারন্যে পাল সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।
এ শিল্পের প্রাণপুরুষ পালদের বর্তমানে চলছে চড়ম দুর্দিন। মৃৎশিল্প মানুষের উদ্ভাবিত প্রারম্ভিক শিল্পকলার একটি। বাংলাদেশের লোকজ কারুকাজে মৃৎশিল্পের কারিগরদের অবদান অনস্বীকার্য। মাটি দিয়ে তৈরি নানা রকম বাহারী নজরকাড়া তৈজসপত্র আমাদের নান্দনিক জীবন ও সংস্কৃতিকে করেছে আরো বিকশিত। আবহমান বাংলার লোক শিল্পের বিকাশ ঘটে প্রধানত মৃৎশিল্পের তৈরি পণ্যের মাধ্যমে।
ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দ‚রে উত্তর-প‚র্ব দিকে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার অবস্থান। নিকলী উপজেলা এক সময় মৃৎশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। বর্তমানে এই শিল্পের সাথে জড়িত ৩২টি পরিবারের প্রায় ২৫০ সদস্য জড়িত আছে। ঘোড়া উত্রা নদীর কোল ঘেষে পাল সম্প্রদায়ের বসবাস।
সেখানে মৃৎশিল্প তৈরি করতে সুবিধা ছিল নৌকা দিয়ে মাটি আনতে ও মৃৎপণ্য পৌছাতে। যার কারণে বেশির ভাগ পাল স¤প্রাদায়ের বসবাস হয় নদীর তীরে। আবার সেখান থেকে নদী পথে যাতায়াত বা মালামাল এদিক সেদিক নিতেও ছিল অনেক সুবিধা। এই কারণে বেশির ভাগ পালদের নদীর পাড়ে কাজ করতে দেখা যায়, আর নিকলীতে তাদের আবাসস্থল ছিল ঘোড়া উত্তরা নদীর তীর।
নিকলী উপজেলার সদর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামের দিনেশ পালের ছেলে হরিদাস পাল পূর্বপুরুষ থেকেই এই মৃৎশিল্পের সাথে জড়িত। বয়সের ভারে তিনি আর তেমন কাজ করতে পারেন না। তার তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলে এই ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাকি দুই ছেলেকে নিয়ে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে এখনো পূর্বপুরুষের পেশাটিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
এ বিষয়ে একই গ্রামের হরিদাস পাল বলেন, এক সময় এই ব্যবসা করে পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাতাম। কিন্তু বর্তমানে আধুনিকায়নের ফলে বাজারে টিকে থাকতে পারছি না। কারণ বাজারে প্লাস্টিক পণ্যে সয়লাব হওয়ার কারণে মাটির তৈরি পণ্য আর কেউ ক্রয় করতে চায় না।
আবার এই কাজের জন্য মাটি কিনে আনতে দ্বিগুণ টাকা লাগে, বর্তমানে অনেক পুঁজির প্রয়োজন বাজারে সব জিনিসের দাম ঊর্ধ্বগতির জন্য অল্প টাকায় এই ব্যবসা এখন আর হয় না। সেজন্য কাজের তুলনায় প্রয়োজনীয় পুঁজিস্বল্পতার কারণে এবং শ্রমের তুলনায় ন্যায্য পারিশ্রমিক না পাওয়াই এই পেশার নৈপুণ্যতা হারাতে বসেছে বলে জানান।
ইতোমধ্যে অনেকেই জীবিকার তাগিদে ভিন্ন পেশায় চলে গিয়েছে, ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্প। নিকলী উপজেলার সদর ইউনিয়নের পালপাড়া মহর কোনা সহ বিশাল এলাকায় মৃৎশিল্পের কাজ বেশি হত। কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার প্রায় প্রতিটা উপজেলায় মৃৎ শিল্পী রযেছে বর্তমানে মৃৎশিল্পীদের পারিবারিক অবস্থা খুবই নাজুক।
উপজেলার পালপাড়া গ্রামের জীবন পাল বলেন, মৃৎশিল্পের কাজ করে আমাদের সংসার চালানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, কি আর বলি আমাদের ছয় ভাইকে রেখে বাবা মারা যান, বাবার মৃত্যুর পর আমার এক ভাইও মারা যায়। আমরা পাঁচ ভাই আমাদের প‚র্ব পুরুষদের ঐতিহ্য মৃৎ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি।
বর্তমান বাজারে মৃৎশিল্পের তেমন কদর নেই, তাই অভাবের তাড়নায় বউ-বাচ্চা-নাতি-পুতিদের নিয়ে কষ্টে জীবনযাপন করছি। এক সময় গৃহস্থালির কাজ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে মাটির জিনিসের কদর ছিল। উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ঘরে শোভা পেত ফুলের টব, কুপি, ফুলদানি, সুকেসে শোভা পেত বাচ্চাদের হরেক রকমের খেলনা পুতুল, হরিণ, গরু, ঘোড়া, মাটির কলসি ইত্যাদি।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বে শহরের সঙ্গে গ্রামের মানুষও যান্ত্রিক হয়ে গেছে, এ সকল কৃত্রিম জিনিসের ব্যবহারে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধছে নানা ধরনের মরণব্যাধি। পরিবেশ হয়েছে দারুনভাবে বিপর্যস্ত। মানুষ প্লাস্টিক, মেলামাইন, সিরামিক, সিলভার ইত্যাদি জিনিসপত্র কিনলেও পরিবেশ বান্ধব মাটির জিনিসপত্র আর কিনছে না।
সে কারণে বেকার হয়ে যাচ্ছি আমরা এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশ থেকে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য মৃৎশিল্প একদিন মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। মৃত শিল্পের ব্যবহার ও উপকারিতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা এবং বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এখনি সরকারের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
হরিদাস পালের ছেলে খোকন পাল বলেন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের কারু শিল্পী পুরস্কার ১৪৩০ মৃৎশিল্পের বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কারো গৌরব নির্বাচিত হয়েছিলাম তারপর ও সরকার বা কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাইনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আসিফ ইমতিয়াজ মনির এ প্রতিনিধিকে বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন শীর্ষ প্রকল্পের আওতায় নিকলিতে ৬ জন মৃত শিল্পীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতি জনকে ১৮,০০০ টাকা করে মোট ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে।
উপজেলা পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মৃৎশিল্পীদের আধুনিকায়নে ২০ জন প্রান্তিক পেশাজীবী মৃৎশিল্পীকে ১০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, নিকলী সদর পালপাড়ায় আর এস এস সুদ মুক্ত ঋণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে,
এ প্রকল্পের মাধ্যমে উক্ত গ্রামে ৬ জন মৃৎশিল্পীকে জন প্রতি ৫০০০০ টাকা করে মোট ৩ লক্ষ টাকা ঋণ প্রদান করা হয়েছে। ভবিষ্যতে মৃৎশিল্পীদের জীবন মান উন্নয়নে এবং এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া হবে।