আজ আমরা যে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছি, সিনেমা-নাটক বা হালের ওয়েস সিরিজ বানাচ্ছি তা একদিনে সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন ব্যক্তির নিরলস শ্রম-মেধায় কালক্রমে তা শানিত হয়েছে। ক্যামেরা-ছবি ও সিনেমার সেই পথ পরিক্রমা নিয়ে আমাদের এই ধারাাহিক আয়োজন। আজ থাকছে ১ম-পর্ব…
পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষ যেমনি বুদ্ধিমান, তেমনি কৌতুহলী প্রাণী। আর তাই মানুষের চাহিদা ও স্বপ্নের শেষ নেই। থেমে নেই চাহিদা পূরণ ও স্বপ্নের বাস্তবায়নে অনন্ত চেষ্টার। যখন কারো একজনের মাথায় ঢুকল, কী ভাবে মানুষের ছবি তোলা যায়, তখন থেকেই সময়ের ¯্রােতে বিভিন্ন জন অবদান রেখে গেছেন ক্যামেরা আবিষ্কার ও এর উন্নয়নে। ক্যামেরা হচ্ছে আলোকচিত্রগ্রাহী যন্ত্র, যার মাধ্যমে আলোকচিত্র (ফটোগ্রাফ) গ্রহণ ও ধারণ করা হয়। দৃশ্যমান স্থির বা গতিশীল ঘটনা ধরে রাখার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। ক্যামেরা হচ্ছে চিত্র রেকর্ড করতে ব্যবহৃত একটি অপটিক্যাল যন্ত্র। আবিষ্কারের পর থেকেই ভিডিও ক্যামেরা আসার আগ পর্যন্ত ‘স্টিল ক্যামেরা’ নামেই পরিচিত ছিল। শুরুর দিকে মানুষের অবয়ব, বিভিন্ন শখের বস্তু, ইমারত ও নৈসর্গিক দৃশ্যকে ধারণের যন্ত্র হিসেবে ক্যামার ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে শুরু হয় কলম ও রঙ-তুলির ব্যবহার। তারপর কাপড়, কাগজ ও পাথরের ওপর ছবি আঁকার প্রচলন শুরু হতে থাকে। স্মৃতি রক্ষার্থে মানুষের ছবি, ইতিহাসখ্যাত ইমারত, ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃশ্য ও শখের বস্তুকে কলম অথবা রঙ-তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে ধরে রাখার চেষ্টা চালায় মানুষ। ক্যামেরার ইতিহাস শুরু হয়েছিল ফটোগ্রাফির প্রচলনের আগেই। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়- সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্ভবত ইতালিতে ‘অবস্কিউরা’ ক্যামেরার নশার পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। ১৮ শতকে এক চিত্রশিল্পী ‘অবস্কিউরা’ ক্যামেরার চিত্র আঁকেন এবং তার প্রয়োগ করেন। প্রাচীনতম নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে- প্রায় ৪৭০ থেকে ৩৯১ খ্রিস্টপূর্বে হান চীনা দার্শনিক মোজি’র আবিষ্কৃত তত্ত¡ ‘ ক্যামেরা অবস্কিউরা হলো ইমেজের উল্টোটা তার উৎস থেকে সরল রেখায় আলোর ভ্রমণের ফল’। ১০২১ সালে ইরাকের পদার্থ বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইসাম (আলহাজেন) আলোক বিজ্ঞানের ওপর ‘কিতাব আল মানাজির’ নামে সাত খণ্ডে একটি বই লিখেছিলেন আরবি ভাষায়। সেখান থেকে ক্যামেরার উদ্ভাবনের প্রথম সূত্রপাত। ১৫৬০ সালে রোলামো কারদানো নামের জার্মান বিজ্ঞানী ক্যামেরাতে প্রথম লেন্স সংযোজন করেন। তখন ক্যামেরায় এই লেন্স ব্যবহার করে শুধু ছবি আঁকা হতো। তখনও আবিষ্কৃত ওই ক্যামেরা দিয়ে কোনো প্রকার ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। ১৬৮৫ সালে সর্বপ্রথম ইয়োহান যাহ্ন ক্যামেরার নতুন একটি ধারণা দেন যেটি ফোটেগ্রাফির জন্য ক্যামেরার ছোট এবং হালকা আকৃতি দেয়। তবে তার ধারণাটিও প্রায় ১৫০ বছর আগের একটি অ্যাপ্লিকেশন থেকে নেয়া। ১৭তম শতাব্দীর পর থেকে তাঁবু এবং বাক্সে বহনীয় ক্যামেরা অবস্কিউরা ডিভাইসের একটি অঙ্কন এইড হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ফোটোগ্রাফিক প্রসেস উদ্ভাবনের পূর্বে ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি সংরক্ষণ করার কোন উপায় ছিল। ফটোগ্রাফি ক্যামেরার বিকাশের শত শত বছর আগে থেকেই মানুষ জানত যে, সূর্যের আলোর সংস্পর্শে এলে রূপালী লবণের মতো কিছু পদার্থ অন্ধকার হয়ে যায়। হেনরিখ শুল্জ দেখিয়ে ছিলেন যে লবণের অন্ধকার শুধুমাত্র আলোর কারণে হয়েছে এবং তাপ বা বাতাসের সংস্পর্শে প্রভাবিত নয়। এটি একবার অন্ধকার হয়ে গেলে অ্যামোনিয়া দ্রবণে অদ্রবণীয় হয়ে যায়। এই রসায়ন ব্যবহার করে প্রথম ছবি তৈরি করেছিলেন টমাস ওয়েজউড। ছবি তৈরিতে ওয়েজউড সিলভার নাইট্রেট দিয়ে লেপা সিরামিক পাত্রের উপর পাতা এবং পোকার ডানার মতো জিনিসপত্র রেখে সেটা আপটিকে আলোতে উন্মুক্ত করেছিলেন। এই চিত্রগুলি স্থায়ী ছিল না। টমাস ওয়েজউড একটি ফিক্সিং প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেও বর্থ হন। ১৮২০-এর দশকের মাঝামাঝি ফরসি বিজ্ঞানী জোসেফ নিসেফর নিপসে চার্লস এবং ভিনসেন্ট শেভালিয়ারের তৈরি একটি কাঠের বাক্স ক্যামেরা ব্যবহার করে তাতে জুডিয়ার বিটুমেনের সাথে পাতলাভাবে প্রলেপযুক্ত পৃষ্ঠের উপর ফটোগ্রাফি নিয়ে পরীক্ষা করেন। ক্যামেরার ইতিহাসে একটি মাইলফলক ছিল ১৮২৬ সাল। সে বছর প্রথমবারের মতো ক্যামেরা ইমেজের স্থায়ী ছবি তৈরি করেন (আলোকচিত্র ধারণ) জোসেফ নিসেফর নিপসে। এরপরই বিশ্বব্যাপী ক্যামেরার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দ্রতবেগে সম্প্রসারিত হতে থাকে। নিপসে ডেগুরি’কে নিয়ে তার হেলিওগ্রাফিকা প্রক্রিয়া উন্নত করার প্রয়াস চালিয়ে যান ১৮৩৩ সালে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত।